
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটির অংশগ্রহণ আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোর বাস্তবতা মোটেই আশানুরূপ নয়। কমিউনিটির অংশগ্রহণ কিছুটা আছে। তবে বিশেষ শ্রেণির কিছু বিদ্যালয় ছাড়া প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সেই অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া, উদ্দেশ্য এবং ফলাফল ভিন্ন। আমরা সঠিক প্রক্রিয়ায় কমিউনিটিকে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারিনি আসলে। তবে পর্যাপ্ত না হলেও কিছু কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পূর্বে কোনোরূপ যোগ্যতাসূচক কোনো শর্ত পূরণ না করেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হতে পারলেও ২০১৯ সালের পর থেকে স্নাতক পাস ছাড়া কেউ আর সভাপতি হতে পারছেন না। এতে প্রথমিক বিদ্যালয় পরিচালনায় কিছুটা ধনাত্মক পরিবর্তন আসা শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। তবে স্নাতকগণের মধ্য থেকে অধিকতর যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিবর্গকে নির্বাচিত করা গেলে সুফলের মাত্রাটি বাড়বে বলে আশা করা যায়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এবং কলেজের ক্ষেত্রেও প্রাথমিকের মতো সুফল পাওয়ার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ন্যূতম যোগ্যতা এইচএসসি পাশ নির্ধারণ করে বিধান হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তবে এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন অনেকেই (সমকাল, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। যাঁরা আপত্তি করেছেন তাঁদের মতে প্রাথমিকের মতো এক্ষেত্রেও সভাপতির ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক পাস বা এর চেয়ে বেশি হওয়া উচিত।
অপরদিকে, অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচন করে যেভাবে দু’একজনকে কমিটির সদস্য হিসেবে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা হচ্ছে তাও কার্যকর হচ্ছে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। কারণ, অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচনেও কোনোরূপ শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অন্যান্য যোগ্যতা নির্ধারণ না করায় বিদ্যালয়ের মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম অভিভাবকগণ নির্বাচিত হয়ে আসছেন না। অপরদিকে অযোগ্যরা বিভিন্ন পন্থায় নির্বাচিত হয়ে এসে বিদ্যালয়কে সহায়তা করার পরিবর্তে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বরং। এছাড়া, বিশেষ করে গ্রামের বিদ্যালয়ের সচেতন ও শিক্ষিত অভিভাবকগণের মাঝে তাদের সন্তানদের শহরের বিদ্যালয়ে পাঠানোর একটি শক্তশালী ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। এটিও বিভিন্ন যুক্তিসংগত কারণেই হচ্ছে। এর ফলে গ্রামের যে সকল অভিভাবকের সন্তানরা শহরের বিদ্যালয়ে যাচ্ছে সেই অভিভাবকগণ তাদের গ্রামের বিদ্যালয়ের ভালো-মন্দ নিয়ে আগের মতো চিন্তা করছেন না। অপরদিকে শহরের যে বিদ্যালয়ে গ্রামের ছাত্ররা যাচ্ছে সেই বিদ্যালয়গুলো হতে আবার সেই ছাত্রের অভিভাবকগণকে দূরত্বের কারণেই ডাকা হচ্ছে না। যারা ডাক পাচ্ছেন তাদের সন্তানরা আবার হয়তো সেই বিদ্যালয়ে পড়ছে না। এতে তারাও খুব আন্তরিকভাবে বিদ্যালয়ের উন্নয়নে অবদান রাখতে আগ্রহী হচ্ছেন না।
বিদ্যালয় পরিচালনায় কমিউনিটি অংশগ্রহণকে ফলপ্রসূ করার জন্য এপস্টিইন যে ছয়টি বিষয় নিশ্চিত করার কথা বলেছেন সেগুলোর বেশিরভাগই নিশ্চিত করা যায়নি এখনও। যেমন, বিদ্যালয়গুলো কমিউনিটির সঙ্গে সার্বক্ষণিক ও কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি, আমাদের অভিভাবকগণ সত্যিকারের প্যারেন্টিং-এর সঙ্গে এখনও পরিচিত নন, সকল অভিভাবক তাদের সন্তানদের পাঠ নিয়ে ভাবেন না বিধায় তাদের দিক থেকে কার্যকরী সহযোগিতাও ছাত্ররা পায় না। অন্যদিকে, সমাজের সুশীলগণকেও পরামশের্র বিদ্যালয়ে জন্য ডাকা হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এখানে কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের উপস্থিতিও অনুভূত। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সমাজের বিজ্ঞ ব্যক্তিগণকে বিদ্যালয়ে পরামশের্র জন্য ডাকার বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারছেন না। এ সকল কিছুর জন্যই বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় কমিউনিটির ফলপ্রসূ সংশ্লেষ নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে এই সংশ্লেষ থেকে যে ধরনের সুবিধা পাওয়া সম্ভব ছিল তাও পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ কমিউনিটির সৎ, শিক্ষিত ও সর্বোপরি বিদ্যালয়ের উন্নয়নে অবদান রাখতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিবর্গকে সঠিক উপায়ে বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা গেলে বিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগ সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব। এক্ষেত্রে কমিউনিটিও স্বপ্রণোদিত হয়ে সংযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কারণ, বিদ্যালয় এবং কমিউনিটি উভয় পক্ষ থেকে সম্মিলিত একটি প্রচেষ্টাই কেবল আলোচ্য অংশগ্রহণের প্রক্রিয়াটিকে ফলপ্রসূ করতে পারে। আশার কথা হলো, দেশের বিভিন্ন জায়গায় সমাজের বিত্তশালী কিছু ব্যক্তি তাদের নিজ নিজ এলাকার বিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে কাজ করা শুরু করছেন ইদানীং। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সংশ্লিষ্টতা আর্থিক সমস্যা দূর করতে পারলেও সেটিই যথেষ্ট নয়। কারণ এতে সর্বজনীনতার অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে বিদ্যালয়গুলো ওপর দীর্ঘমেয়াদে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ায় ফলাফল ঋণাত্মক হতে পারে। তাই কমিউনিটির অংশগ্রহণকে সফল করতে হলে কমিউনিটির সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্যকে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করতে হবে।
মন্তব্য করুন