- মতামত
- বিস্ফোরণের বহুমাত্রা
বিস্ফোরণের বহুমাত্রা
রাজধানীর সিদ্দিকবাজার এলাকায় ‘সাততলা ভবন’ বলিয়া পরিচিত একটি বাণিজ্যিক স্থাপনায় মঙ্গলবার অপরাহ্ণে সংঘটিত বিস্ফোরণটি যে কোনো মানদণ্ডেই ‘ভয়াবহ’ বিবেচিত হইতে বাধ্য। বস্তুত বুধবার অপরাহ্ণ পর্যন্ত অন্তত ২০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হইবার এই ঘটনা সংখ্যাগত দিক হইতেই ইহার ভয়াবহতা প্রতিপন্ন করে।
বিস্ফোরণের মাত্রা কতটা গভীর–আলোচ্য ভবনটির অভ্যন্তরে অবস্থানকারীদের কেহ কেহ তো বটেই; সম্মুখের সড়কের পথচারী, যাত্রী ও ভাসমান দোকানিগণ হতাহত হইবার মধ্য দিয়াই উহা স্পষ্ট। অস্বীকার করা যাইবে না– চার শতাব্দীপ্রাচীন এই নগরীতে দুর্ঘটনা প্রায় নৈমিত্তিক। পরিবহন দুর্ঘটনা ব্যতীতও ভবন বা অবকাঠামোয় ধস, অগ্নিকাণ্ড, গ্যাস বিস্ফোরণ, বৈদ্যুতিক গোলযোগ প্রভৃতি ক্ষুদ্র-বৃহৎ দুর্বিপাক আমরা প্রায়শ প্রত্যক্ষ করি। সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে এই সকল দুর্যোগের সহিত যুক্ত হইয়াছিল জঙ্গিবাদী প্রপঞ্চ। কিন্তু সিদ্দিকবাজারের দুর্ঘটনাকে সেই চেনা ছকে ফেলা যাইতেছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও উদ্ধারকারী দলের পক্ষ হইতে ইতোমধ্যে জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে–বিস্ফোরণটির সহিত নাশকতা কিংবা সন্ত্রাসী তৎপরতার সম্পর্ক নাই। বরং ভবনের ভূতলে অবস্থিত ও সংযুক্ত সরবরাহ লাইন, সেপটিক ট্যাঙ্ক, পয়ঃনিষ্কাশন পাইপ, জলাধারে পুঞ্জীভূত, এমনকি জেনারেটর হইতে নির্গত গ্যাসের কারণেই এহেন বিস্ফোরণ ঘটিতে পারে। তবে কোনো আশঙ্কাই উড়াইয়া দেওয়া উচিত হইবে না। নিঃসন্দেহ হইবার জন্য যদিও পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনপ্রাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা শ্রেয়; এই ব্যাপারে সন্দেহ নাই– সিদ্দিকবাজারের দুর্ঘটনা ঢাকা নগরীর নিরাপত্তা লইয়া নূতন শঙ্কা তৈরি করিয়াছে। শুধু এই বিস্ময়ের কারণে নহে যে, জমাট গ্যাস এত বড় বিস্ফোরণ ঘটাইতে পারে। এই কারণেও যে, গত দুই সপ্তাহে খোদ রাজধানীতে অন্তত পাঁচটি বৃহৎ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়াছে। ইহার পূর্বে সায়েন্স ল্যাব, মৌচাক, গুলশান ও কালশী এলাকায় প্রায় অভিন্ন প্রকার বিস্ফোরণ আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। কাকতাল হইয়া থাকিলেও সংশ্লিষ্টরা সকল দিক নিশ্চয় পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখিবেন। ইতোমধ্যে আলোচ্য পাঁচ বিস্ফোরণের ঘটনার প্রায় প্রতিটির বিষয়ে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠিত হইয়াছে।
আমরা মনে করি, কমিটিগুলির মধ্যে সমন্বয় জরুরি, যাহাতে বিস্ফোরণগুলির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক থাকিলে উহা শনাক্ত করা যায়। ইহাও প্রত্যাশা করিব, তদন্ত কমিটিগুলি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তাহাদের কাজ সম্পন্ন করিয়া প্রতিবেদন জমা দিবে। অতীতে বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি গঠিত হইলেও পরবর্তী সময়ে উহার ‘ফলোআপ’ দেখা যায় না। কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও তাহা জনপরিসরে প্রকাশিত হয় না। এ ক্ষেত্রে উহার পুনরাবৃত্তি কাম্য নহে। স্মর্তব্য, এক অর্থে ‘নূতন’ ধরনের এই বিস্ফোরণের যথার্থ কারণ অনুসন্ধান ব্যতীত ভবিষ্যতের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা সম্ভব হইবে না। আর অন্যূন দুই কোটি জনসংখ্যার ঘনবসতির এই নগরীতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার সামান্য গলদও যে প্রাণঘাতী হইয়া উঠিতে পারে, উহার নজির আমরা অতীতে অনেকবারই পাইয়াছি।
আর যে কথাটি তদন্ত প্রতিবেদন ব্যতিরেকেই বলিয়া দেওয়া যায়– তদারকি সংস্থাগুলি যদি নগরীর বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনগুলি নিয়মিত পরিদর্শন ও নজরদারি করিত, তাহা হইলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস পাইত। সিদ্দিকবাজারের ভবনটির ক্ষেত্রে দেখা যাইতেছে, প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে তৎকালীন ডিআইটি হইতে অনুমোদিত হইয়াছিল। উহার পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে, কিন্তু পরিদর্শনে গিয়াছে কিনা, নিশ্চিত হওয়া যাইতেছে না। অনুমোদনের নথিও পাওয়া যাইবে কিনা নিশ্চিত নহে। গ্যাস কোম্পানিগুলি সংযোগ দিবার পর কতটা রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকে– সেই প্রশ্নও রহিয়াছে। বিলম্বে হইলেও তদারকি, নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণ সংস্থাগুলির নিদ্রাভঙ্গ; এই প্রকার দুর্ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা আমাদের প্রত্যাশা। আহতরা যাহাতে উপযুক্ত চিকিৎসা এবং ক্ষতিগ্রস্তরা যথাযথ ক্ষতিপূরণপ্রাপ্ত হন, সেই ব্যবস্থা করিতে হইবে সর্বাগ্রে।
মন্তব্য করুন