- মতামত
- সাম্যবাদী সাহিত্যিক সোমেন চন্দ আজও প্রাসঙ্গিক
স্মরণ
সাম্যবাদী সাহিত্যিক সোমেন চন্দ আজও প্রাসঙ্গিক

এবারের অমর একুশে বইমেলায় সোমেন চন্দ চর্চাকেন্দ্রের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে ‘শতবর্ষে সোমেন’। দুই বাংলার ২৬ জন গুণী মানুষ সমৃদ্ধ ও সুসম্পাদিত সংকলনটিতে লিখেছেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ফ্যাসিবাদবিরোধী সমাবেশে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে রেল শ্রমিকদের মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় রাজনৈতিক বিরোধীদের হাতে খুন হয়েছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠক ও সাম্যবাদী সাহিত্যিক সোমেন চন্দ। বস্তুত উদার ও সাম্যবাদী কর্ম ও লেখাই কাল হয়েছিল তাঁর জন্য। অকালে প্রাণ হারানো এই তরুণ বিপ্লবীর জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত গ্রন্থটি পাঠের মধ্য দিয়ে নতুন করে সোমেন চন্দকে অনুভব করতে পেরেছি বলে মনে হয়।
গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে সোমেন চন্দ সাম্যবাদে আগ্রহী ও ব্রতী হয়ে উঠেছিলেন। তখন তাঁর ১৮-১৯ বছর বয়স। ঢাকার ছেলে। বাবা রেলের কর্মচারী। বয়স আর সামাজিক অবস্থানের বিচারে সোমেনের এমন রাজনৈতিক আগ্রহ মোটেও অবাক করে না। তবে সাম্যবাদী রাজনীতিতে আগ্রহী সে সময়কার অন্য সব প্রতিশ্রুতিশীল তরুণের মধ্যেও তিনি আলাদা ছিলেন। কারণ তিনি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে মেহনতি শ্রমিক শ্রেণির সংযোগ সাধনে নিয়োজিত হয়েছিলেন। এ জন্য তাঁর ‘পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিজম’ যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি ভূমিকা রেখেছে তাঁর সাহিত্যও।
পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সেকালে সাম্যবাদ আর কমিউনিজমের বিস্তার ঠেকাতে মরিয়া। শাসকরা তাই কমিউনিস্ট পার্টি আর শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ওপর খড়্গহস্ত। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে নেতারা আত্মগোপনে। এই অবস্থায় রেল মজুরদের সংগঠনের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সদ্য কৈশোর পেরুনো সোমেন চন্দ। এই মহতী দায়িত্ব কার্যকরভাবে পালন করেছিলেন ওই অল্প বয়সেই। মেহনতি মানুষের কাছাকাছি ছিলেন বলেই তাঁর সাহিত্যে বঞ্চিত-লাঞ্ছিতদের মর্মবেদনা ও শ্রেণিচেতনা প্রকট অথচ সহজবোধ্যভাবে হাজির হতে দেখি। তাঁর লেখার সাহিত্যগুণও ছিল সুরক্ষিত; মোটেও প্রচারণামূলক ছিল না। শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থের প্রশ্নকে তিনি সাহিত্যের বিষয় হিসেবে এনেছেন।
এটাও ঠিক, শ্রমিক রাজনীতির কর্মসূচিকে শুধু রাজপথ বা মাঠে-ময়দানের বিষয় হিসেবে না রেখে শিল্প-সাহিত্যকেও রাজনীতির অস্ত্র বা কৌশলে পরিণত করেছেন। বলা যায়, শ্রমিক নেতা সোমেন চন্দ ও সাহিত্যিক সোমেন চন্দের সম্পর্কটি দ্বান্দ্বিক; এখানে দুটি পরিচয় পরস্পরকে ‘রি-ইনফোর্স’ করেছে। একে অপরকে শক্তি জুগিয়েছে।
উপমহাদেশে যে ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ সেকালে গণমুখী সাহিত্যচর্চার প্রসার ঘটাচ্ছিল; সোমেন ঢাকায় তাঁর দায়িত্ব পালন করছিলেন। রাজনৈতিক কর্মী ও লেখক-লেখিকাদের মধ্যে একটি সংযোগ সেতু হিসেবে এক অনন্য ভূমিকা সে সময় তিনি রেখেছিলেন। সে সময় যাঁরা সোমেনের সহযোদ্ধা ছিলেন, তাঁরা সবাই শুধু বয়সে তরুণ ছিলেন, তা নয়; তাঁদের চিন্তাও ছিল যুগান্তকারী। ঔপনিবেশিক শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে নিছক লেখালেখির সীমা অতিক্রম করে এরা সবাই তখন সমাজের সাম্যবাদী রূপান্তরের জন্য লিখতে শুরু করেছেন।
স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায়, ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রগতিবাদী লেখালেখিতে যে ধারার উন্নতি সাধন করেছেন; তার শুরু কিন্তু হয়েছিল সোমেন চন্দের লেখালেখির ভেতর দিয়েই। আদতে ঔপনিবেশিক ‘এনলাইটেনমেন্ট’-এর সীমা অতিক্রম করে ত্রিশের দশকে বাংলা সাহিত্যে দরকার ছিল কিছু গণবৈপ্লবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সেখানেই সবাইকে পথ দেখিয়েছেন সোমেন চন্দ। কবিতার ক্ষেত্রে কাজটি করেছেন অকালে হারানো আরেক বিপ্লবী সুকান্ত ভট্টাচার্য।
স্বাধীনতা ও সাম্যবাদের আদর্শে সোমেনের কাজকর্ম পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গে যাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছে তাঁদের মধ্যে আছেন– মুনীর চৌধুরী, সৈয়দ নুরুদ্দিন, সানাউল হক, কবীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম। এ প্রসঙ্গে সরদার ফজলুল করিম ১৯৮২ সালে লিখেছেন– ‘সোমেনের নির্মমভাবে নিহত হওয়ার ঘটনাই হয়তো চুম্বকের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম প্রগতিশীল সাহিত্যকর্মীদের আকর্ষণ করে নিয়ে গিয়েছিল প্রগতি লেখক সংঘের অনুষ্ঠানে, আলোচনায়, ক্রিয়াকর্মে। আমার ভাগ্য, আমিও সে আহ্বানের বাইরে সেদিন থাকতে পারিনি।’
চল্লিশের দশকে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এক বড় সংকট হিসেবে হাজির হয়েছিল। সোমেনের গল্প ‘দাঙ্গা’-তে সেই ভয়াবহতাকে দেখা হয়েছে একজন পরিবর্তনকামী শ্রেণিসচেতন তরুণ রাজনীতিকের চোখ দিয়ে। আলোচ্য গ্রন্থে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেখিয়েছেন গল্পকার গল্পের প্রোটাগনিস্ট অশোককে দিয়ে সাম্প্রদায়িক ‘হিন্দু সোস্যালিস্ট’ ছোট ভাইয়ের উদ্দেশে বলাচ্ছেন– “আজ বাদ কালের কথা মনে পড়ে যখন ‘হিন্দু-মুসলমান ভাই-বোনেরা’ বলে গাধার ডাক ছাড়বি? তখন তোর গাধার ডাক শুনবে কে?” একইভাবে সোমেন তাঁর ‘ইঁদুর’ গল্পে দেখিয়েছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়, এ দেশের মেহনতির শত্রু হলো দারিদ্র্য।
কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর ভূমিকায় লিখেছেন– ‘‘সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোটগল্প ‘ইঁদুর’ পড়ার পরই নিম্নমধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুতীব্র ইচ্ছা হয়। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার ও মনসুবিজন নামে তিনটি গল্প প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলি।”
সোমেনের রাজনীতি ও সাহিত্য ছিল মাটিঘেঁষা, জনসংশ্লিষ্ট। অল্প বয়সে খুন না হয়ে গেলে সোমেন এ ভূখণ্ডের রাজনীতি ও সমাজে যে ভূমিকা রাখতে পারতেন, তা ‘স্পেকুলেট’ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পেয়েছি– একজন মাটিঘেঁষা তরুণ রাজনীতিক যদি পরিণত বয়স পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়ে যেতে পারেন, তাতে কী দারুণ পরিবর্তনই না সম্ভব! মানুষের মুক্তি ও সাম্যের যারা শত্রু, তারা বঙ্গবন্ধুকেও শারীরিকভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর দেখানো স্বপ্ন আমাদের সামনে আজও টিকে আছে। ঠিক যেমন আমাদের সামনে আছে সোমেন চন্দের স্বপ্নের প্রতিলিপি হিসেবে তাঁর সাহিত্য।
ড. আতিউর রহমান: অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
মন্তব্য করুন