ব্রহ্মপুত্রের শহর ময়মনসিংহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসছেন আজ। তাঁর সভাস্থল থেকে ব্রহ্মপুত্রের দূরত্ব একশ গজের মতো। মূলত ব্রহ্মপুত্রকে কেন্দ্র করেই ময়মনসিংহ শহরের গোড়াপত্তন এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলটি ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্ভরশীল। ব্রহ্মপুত্রের পলি ভরাটে জনপদটি গড়ে উঠেছে এবং ব্রহ্মপুত্রের শাখা-প্রশাখা মিলে এলাকাকে করেছে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা। কাজেই ব্রহ্মপুত্রের বাঁচা-মরার সঙ্গে এই বৃহৎ এলাকার জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মাছসহ জলজ প্রাণী, পরিবহন এবং কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। সেই ব্রহ্মপুত্র আজ বিপন্ন। এ জন্য প্রাকৃতিক কারণ যেমন দায়ী, তেমনি আছে মানবসৃষ্ট নানা উপসর্গ। দ্বিতীয় কারণটি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের দুই তীরে দখল চলছে। সেখানে কারখানা ও নগরের বর্জ্য দূষণ ছড়াচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। বর্তমান সরকারের আমলে ব্রহ্মপুত্রে খননকাজ শুরু হওয়ায় মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, খনন শেষ হলে এ নদ দিয়ে জাহাজ চলবে। সম্প্রসারিত হবে পর্যটন। কিন্তু খননের শেষ পর্যায়ে এসে মানুষ দেখছে, ব্রহ্মপুত্রের সীমানাই নির্ধারণ করা হয়নি। হাজার হাজার দখলদারের দখল অব্যাহত আছে। আশঙ্কার বিষয়, নদ খনন করা হচ্ছে ১০০ মিটার প্রশস্ত করে। তার পাশেই বড় বড় বালুর স্তূপ। সেই সব স্তূপীকৃত জায়গা নতুন করে দখল হচ্ছে। এতে ব্রহ্মপুত্র আরও সংকীর্ণ এবং বাধাগ্রস্ত হয়ে হচ্ছে বিপন্ন। বর্ষায় বন্যায় যেটুকু পানি ব্রহ্মপুত্র দিয়ে প্রবাহিত হয়, তার জন্য ১০০ মিটার খুবই সংকীর্ণ এবং অপর্যাপ্ত জায়গা। তার ওপর কোথাও কোথাও নদের স্বাভাবিক গতিপথ পরিবর্তন করে সরল করা হচ্ছে। যেখানে নদের ধারা একাধিক ছিল, সেখানে একটি ধারা রেখে অপরটি বন্ধ করা হচ্ছে। এটি নদের স্বার্থবিরোধী। এতে স্বাভাবিক প্রবাহ বিনষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়গুলো জাতীয় মনোযোগ দাবি করে। আমাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার সঙ্গেও এটি যুক্ত।

আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলি:
১) খননের নামে ব্রহ্মপুত্র নদকে খালে পরিণত করা চলবে না।

২) ১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী নদনদী ও জলাশয়ের সীমানা নির্ধারণ করে পিলার বসাতে হবে।

৩) পরিপূর্ণ দখলমুক্ত করে নদনদীর স্বাভাবিক গতিধারা ফিরিয়ে আনতে হবে।

৪) কলকারখানা এবং নগরের বিষাক্ত বর্জ্য ও আবর্জনা নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে।

৫) প্রাণ-প্রকৃতির শত্রু প্লাস্টিক-পলিথিন নিষিদ্ধ করতে হবে।

৬) নদী ও খালে ঝুলন্ত সেতু তৈরি করতে হবে।

৭) সব নদী-খালের বাঁধ অপসারণ করে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

পরিতাপের বিষয়, এসব দাবি যৌক্তিক হলেও রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায় না। ফলে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রে ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ের খননকাজ চলমান থাকলেও তার প্রবাহ বাড়েনি। বরং দখল-দূষণ বাড়ছে ভয়ানক আকারে। বালুর ব্যবসার প্রসার হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী ময়মনসিংহ আসছেন। শোনা যাচ্ছে, তিনি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও উদ্বোধন করবেন। কিন্তু ময়মনসিংহের প্রাণভোমরা ব্রহ্মপুত্রকে বাদ দিলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। স্থানীয় প্রশাসনকে বারবার বলেও কোনো কাজ হয় না। বাংলাদেশের চলমান ক্ষমতা কাঠামো অনুযায়ী একমাত্র প্রধানমন্ত্রী চাইলেই ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ রক্ষা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

আমরা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার সাধারণ মানুষ জোর দাবি জানাচ্ছি– প্রধানমন্ত্রী ব্রহ্মপুত্রের দুর্দশার চিত্র নিজ চোখে দেখুন। বিপন্ন ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিন। খনন প্রকল্পটির পুনর্মূল্যায়ন করুন। ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।

আবুল কালাম আল আজাদ: সমন্বয়ক, ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন