
১৯৯০ সালের পরে দীর্ঘ ২৮ বছর পেরিয়ে সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালের মার্চ মাসে। সেই নির্বাচনের মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ না নেওয়ায় চার বছরেও হয়নি ডাকসুর নতুন নির্বাচন। পরবর্তী নির্বাচন কবে হবে তা এখনও জানা যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু শিক্ষক সমিতি, অফিসার অ্যাসোসিয়েশন, সাংবাদিক সমিতি, কর্মচারী সমিতি, চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতিসহ সব সংগঠনেরই নির্বাচন হচ্ছে নিয়মিত। হচ্ছে না কেবল ডাকসু নির্বাচন। ডাকসু নির্বাচন কেন হচ্ছে না? কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন আয়োজনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না? নাকি নির্বাচন আয়োজনে বিশ্বাবিদ্যালয় প্রশাসন কোনো বিশেষ আদেশ পাচ্ছে না?
আমরা স্মরণ করতে পারি, শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি-দাওয়া ও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ বছর পর ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সব প্যানেল নির্বাচন বর্জন করেছিল। দিনে নির্বাচন শেষ হলেও ভোট গণনা করে ফল প্রকাশ করতে ভোররাত হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনে ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক ছাড়া ২৩টি পদে জয়লাভ করেছিল ছাত্রলীগ। সেই কমিটি ২৩ মার্চ দায়িত্ব নিয়েছিল। ডাকসুর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২৩ মার্চ ডাকসুর মেয়াদ শেষ হয়েছে। তারপর বর্ধিত ৯০ দিন পেরিয়েছে বহু আগে। সেই সময়ে মহামারি করোনার দোহাই দিয়ে নির্বাচন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডাকসু নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক নয়। যদিও আইনে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ই সিদ্ধান্ত নেবে। বাস্তবে এই সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সরকার এখন ডাকসু নির্বাচন দিতে চায় না বলেই দেখা যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া সরকারের চিন্তায় ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ভাবনা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না। তবে গত ডাকসু নির্বাচন করতে গিয়ে দেশব্যাপী যে আলোচনা তৈরি হয়েছে, সেখানে বলা যায় আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে সরকার আগ্রহী হবে না।
আমরা ডাকসুর নেতৃবৃন্দের দিকে তাকালে দেখতে পাই, এখান থেকেই জাতীয় রাজনীতির বহু নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। তাদের অনেকে দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছাত্রনেতারা বলে থাকেন, যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির কারখানা হলো ডাকসু। শুধু রাজনীতি নয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ধারায় ডাকসু সবসময়ই সক্রিয় ছিল। তারা ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছে। কথা বলেছে শিক্ষা এবং শিক্ষার অধিকার নিয়েও। দীর্ঘ ২৮ বছর ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় রাজনীতিতে এক ধরনের নেতৃত্বশূন্যতা তৈরি হয়েছিল। ডাকসুর মধ্য দিয়ে অনেক তরুণ নেতৃত্ব বেরিয়ে আসছে। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নুরুল হক নুরের মতো অনেক রাজনৈতিক নেতা বের হয়ে আসছেন। রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে ডাকসুর ভিপি নুর এখন দেশের রাজনীতিতে আলোচনায় থাকছেন। ডাকসু থেকে এর আগেও বহু ছাত্রনেতা জাতীয় নেতায় পরিণত হয়েছেন। সরকারের মন্ত্রী হওয়া থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কেবল ডাকসু নয়, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ কার্যকর না থাকায় বর্তমান ছাত্ররাজনীতি গৌরব হারাতে বসেছে।
এখন কেউ কেউ বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে, এমন কথা বলে এই নির্বাচন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আমরা এটা বিশ্বাস করি না। আমরা মনে করি, অনতিবিলম্বে ডাকসুসহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া উচিত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনী শিক্ষার প্রাথমিক ধাপটি শিক্ষা জীবনেই শিখে নিতে দোষ কোথায়?
এহ্সান মাহমুদ: সহ-সম্পাদক, সমকাল
মন্তব্য করুন