গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন সময় সরকার উদ্যোগ নিলেও স্থায়ী সুফল পাচ্ছেন না যাত্রীরা। বাস, ট্রেন, লঞ্চ– সর্বত্রই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ট্রেনের টিকিট বিক্রিতে কালোবাজারি ঠেকাতে এবার জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করেছে কর্তৃপক্ষ। এতে কালোবাজারি বন্ধ হবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। বাস বিশেষ করে আন্তঃনগর বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে ই-টিকিট পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে বেশ কয়েকটি রুটে ই-টিকিট চালু হয়েছে। অন্যান্য রুটেও পর্যায়ক্রমে চালু করার কথা জানিয়েছে বিআরটিএ। যদিও চালু হওয়ার সপ্তাহখানেকের মাথায় কোনো কোনো রুটে এটি বন্ধও হয়ে গেছে।

সম্প্রতি এক সকালে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় কর্মস্থলে আসার উদ্দেশ্যে বাসের জন্য দয়াগঞ্জ মোড়ে অপেক্ষা করছিলাম। সাধারণত ২ মিনিট পরপর বাস এলেও সেদিন ৩০ মিনিট অপেক্ষার পর কাঠেরপুল-মোহাম্মদপুর রুটের একটি বাস এলো। বাসের সহকারী জানাল, এটি প্রেস ক্লাবের পর আর যাবে না। কারণ হিসেবে বলা হলো, মৎস্য ভবন মোড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাচ্ছেন। তাই প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে সচিবালয় সড়ক হয়ে আবার কাঠেরপুল ফিরে যাবে। নগরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। এতে যাত্রী ভোগান্তি বাড়ে। আবার কোনো কোনো গণপরিবহন ভ্রাম্যমাণ আদালতস্থল এড়িয়ে চলাচল করে।

চোর-পুলিশের খেলায় যাত্রীদের ভোগান্তি হচ্ছে। এভাবে বলে-কয়ে বা নির্দিষ্ট স্থানে আদালত বসিয়ে অনিয়ম দূর করা যাবে না। কৌশল বদলানো যেতে পারে। বাসে যাত্রীবেশে চড়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সদস্যরা অনিয়ম ঠেকানোর পরিকল্পনা নিতে পারেন। একটি গণপরিবহনকে ৩ হাজার টাকার অর্থদণ্ড দিয়ে হাজার হাজার বাস নিয়মের মধ্যে আনা যাবে না। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কারী চালক ও সহকারীকে ন্যূনতম ছয় মাসের কারাবাস দেওয়া গেলে অন্যরা সাবধান হলেও হতে পারে। একই সঙ্গে বাসটি জব্দের পাশাপাশি রুট পারমিট বাতিল করা যেতে পারে। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ বাস আটকালেও কিছু অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দিচ্ছে। এতে একদিকে যেমন অনিয়মকে আশকারা দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে কতিপয় ব্যক্তির অসততায় গোটা পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

জ্বালানির দাম বাড়লেই ঢাকা মহানগরসহ দূরপাল্লার বাসে ভাড়া বাড়ে। দেখা যায়, সরকারের বেঁধে দেওয়া ভাড়ার তুলনায় বেশি আদায় করা হয়। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রতিবাদ করে যাত্রী নাজেহালের খবর নতুন নয়। সিএনজির দাম বাড়লে যেসব বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়, ডিজেলের দাম বাড়লেও সেগুলোর ভাড়া বাড়ে। গত বছর ডিজেলের দাম বাড়ার পর যেসব বাসের সামনে ‘সিএনজিচালিত’ স্টিকার লাগানো আছে,  সেগুলোও অন্য বাসের সমান ভাড়াই আদায় করছে। এ রকম বাস্তবতা যাত্রাবাড়ী-গাবতলী রুটের বাসে প্রতিদিন দেখা যায়।

বিআরটিএ ই-টিকিট পদ্ধতি চালুর পাশাপাশি ওয়েবিল বাতিল করে দিয়েছে। দু-তিন দিন ওয়েবিল পদ্ধতি স্থগিত রেখে আবার পুরোনো পথেই হাঁটছে ঢাকার বাসগুলো। আগে হার্ডবোর্ডের ওপর থাকা কাগজে চেকার যাত্রীর সংখ্যা নোট দিতেন। এখন হার্ডবোর্ডের বদলে টুকরো কাগজে ওয়েবিল নোট দিচ্ছেন। আগে হার্ডবোর্ডে সাঁটানো ওয়েবিল শিট চালকের সামনে খোলামেলা রাখা হতো। এখন সহকারী টুকরো শিটটি পকেটে রাখে, যাতে হঠাৎ ভ্রাম্যমাণ আদালত এলে বলতে পারে– তারা ওয়েবিলে চলে না; কোথাও চেকার নেই।

ই-টিকিট চালু হলে লাভ কতটুকু হবে, তা রুটভিত্তিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কাঠেরপুল-মোহাম্মদপুর রুটের একটি কোম্পানি সপ্তাহখানেক ই-টিকিট চালু রাখে। অনিয়মকারী কোম্পানির তালিকা দীর্ঘ হওয়ায় নির্দিষ্ট একটি কোম্পানির নাম উল্লেখ করলে তাদের প্রতি অবিচার করা হতে পারে। এ রুটের বাসটির দয়াগঞ্জ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ই-টিকিটের ভাড়া দেখাচ্ছিল ১০ টাকা। কিন্তু দয়াগঞ্জ থেকে পল্টন মোড় পর্যন্ত ভাড়া হয়ে যাচ্ছে ১৫ টাকা। সফটওয়্যারে এভাবেই সেট করে নেওয়া হয়েছে। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। এর পর প্রতি কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া বাড়ার কথা। ২০০ মিটার পরই ৫ টাকা বেড়ে যাওয়া ওই ই-টিকিটে কি আদৌ বিআরটিএর নিয়ন্ত্রণ ছিল? নাকি কোম্পানি তাদের পছন্দমতো স্টপেজ অনুযায়ী ভাড়া ঠিক করে নিয়েছে? যদি নেটওয়ার্কিং সিস্টেমের মাধ্যমে কিলোমিটার হিসেবে সফটওয়্যারে ভাড়া না দেখিয়ে মালিকদের চেনানো স্টপেজ অনুযায়ী টিকিট প্রিন্ট হয়, তাহলে এই ই-টিকিট যেই লাউ সেই কদু।      

লঞ্চের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা রুটে ভাড়া কমলেও উপকূলীয় রুটে বেড়েছে দ্বিগুণ। ঢাকা-ভোলা রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা-ইলিশা (ভোলা) রুটে চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত নৌযান যুক্ত হয়েছে। এ মাসে আরও চারটি লঞ্চ যুক্ত হয়েছে। দ্বিগুণ ভাড়া আদায়ের কারণেই কম যাত্রী পরিবহন করেও টিকে আছে এসব লঞ্চ। বিআরটিএ যেমন সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারছে না, একই অবস্থা বিআইডব্লিউটিএর ক্ষেত্রেও। সড়ক পরিবহনের মতোই নৌযান মালিকরা দল-মত নির্বিশেষে প্রভাবশালী।

সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন রেল লোকসান গুনছে। বিআরটিসির লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়। বিআইডব্লিউটিসির নিয়ন্ত্রণাধীন রকেট সার্ভিস তথা স্টিমারের অবস্থাও ভালো না। যদিও চাহিদার তুলনায় বিআরটিসি বাস, স্টিমারের সংখ্যা খুব কম। এ অবস্থায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনার বিষয় বাস্তবসম্মত কিনা, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মত নেওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে। তবে সেট করা তথাকথিত ই-টিকিট দিয়ে যাত্রী হয়রানি যে বন্ধ হবে না– তাতে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়।

মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com