গত কয়েক দিনে তিনটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে দেশে- চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের একটি অক্সিজেন কারখানায়; ঢাকার সায়েন্স ল্যাবের সন্নিকটে একটি তিনতলা ভবনে; সর্বশেষ ঢাকার পুরোনো রেলস্টেশনের নিকটবর্তী সিদ্দিকবাজারে। সিদ্দিকবাজারের ভবনটি ছিল সাততলা। সেখানে অনেক মানুষ নিহত হয়েছেন; আহতও অনেকে। কারও কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক। যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন, অধিকাংশই সাধারণ মানুষ। প্রধানত মেহনত করেই তাঁরা জীবনযাত্রার ব্যয়ভার মেটাচ্ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁরা নিজ নিজ পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। আপনজন হারানোর বেদনার ধকল কাটিয়ে না উঠতেই তাঁদের সামনে যে বাস্তবতা রূঢ় হয়ে দেখা দেবে, সেটি হলো– কে রোজগার করবেন। অথবা এমনও হতে পারে, পরিবারের মধ্যে রোজগার করা বয়সী মানুষই নেই। যেসব পরিবার রোজগেরে একমাত্র সদস্যকে হারিয়েছে, তারা সবচেয়ে বিপদাপন্ন হবে।

কবি সুকান্ত লিখেছিলেন– ‘অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার/ দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।’ মৃত্যু জীবনেরই অংশ। মৃত্যু আছে বলেই জীবন মহামূল্যবান। মানুষমাত্রই মৃত্যুর কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়। অসুখ-বিসুখ নিরাময়যোগ্য না হওয়ার ফলে কারও মৃত্যু হলে সেই মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু তা সহ্য করার একটি যুক্তি আপনজনের মধ্যে থাকে। মৃত্যু সম্পর্কে অনেক ধরনের কথা আছে ধর্মগ্রন্থে; নবী-পয়গম্বরদের নীতিকথায়। মৃত্যু সম্পর্কে দার্শনিকরাও অনেক কথা লিখেছেন। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস বলেছেন, লিভিং মিনস ডায়িং। অর্থাৎ আমরা বেঁচে থাকলেও কিন্তু মরে যাচ্ছি। ১ মিনিট সময় বেঁচে থাকার অর্থ হলো, আয়ু থেকে ১টি মিনিট হারিয়ে যাওয়া। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এত কিছু মানুষ ভেবেছে; তৎসত্ত্বেও আপনজনকে হারালে মানুষের দুঃখ-বেদনার শেষ থাকে না।

ইংরেজিতে কথা আছে– টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার। আপনজনকে হারিয়ে আমরা কিছুদিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি। তারপর কান্নাটা হালকা হতে থাকে; চোখের কোণে একটু পানি জমে; আরও পরে মুখের কথাগুলো বেদনা জড়ানো মনে হয়। এভাবে মানুষ মৃত্যুশোক সামাল দিয়ে ওঠে। নতুন করে বাঁচার প্রতিজ্ঞা করে মানুষ। মৃত্যু সম্পর্কে ইংরেজ কবি তাঁর একটি শোকগাথায় লিখেছেন, ডেথ দি লেভেলার। অর্থাৎ মৃত্যু ধনী-দরিদ্র সবাইকে একই সমতলে নিয়ে আসে। শেষ পর্যন্ত সবাইকে দেহ রাখতে হয় মাটির মধ্যে। গত কয়েক দিনে দুর্ঘটনার ফলে যেসব মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, তা ভাবতে গিয়ে কিছুটা হলেও দর্শনমনস্ক হয়ে উঠতে হয়। মৃত্যু নিয়ে জ্ঞানীগুণীদের কথা স্মরণ করলে কষ্ট অনেকটাই লাঘব হয়। যাঁরা এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের জীবিত আপনজনরা মৃত্যু সম্পর্কে মহৎ ব্যক্তি এবং ধর্মগ্রন্থে যা লেখা আছে তা স্মরণ করলে কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

এ ধরনের দুর্ঘটনা নতুন নয়। এই ঢাকাতেই ঘটেছে নিমতলী ও চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি। এসব ট্র্যাজেডি মানুষেরই সৃষ্টি। দাহ্য পদার্থ নিয়ম অনুযায়ী যেভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তার ব্যত্যয় ঘটলে ভয়াবহ দুর্যোগ ঘটে যেতে পারে। চুড়িহাট্টা ও নিমতলী এর সাক্ষ্য দেয়। আমার জানামতে একটি গ্রামে যে দিনমজুররা ছিল তাদের কয়েকজন রাসায়নিকের ব্যবসায় ভাগ্য বলে ঢুকেছিল। এর পর তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তারা এখন শতকোটি টাকার মালিক। গ্রামে তারা যে ধনী কৃষকের বাড়িতে কাজ করত, সেই বাড়ির বিপরীত দিকে তারা পাঁচতলা ভবন তুলেছে। তারা এখন নিজ গাড়িতে করে গ্রামে যায়। গ্রামের লোকজন তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার প্রশ্ন– যে ব্যবসা করে এত অর্থবিত্ত হয়, সে ব্যবসাটি যাতে নিরাপদ থাকে এবং অন্য মানুষের কোনো ক্ষতির কারণ না হয়, সেভাবেই তো ব্যবসা করা দরকার।

পুরোনো ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকায় রাসায়নিকের গুদাম রাখলে তা থেকে যে কোনো মুহূর্তে মহাবিস্ফোরণ ঘটতে পারে– তা অনুধাবন করা তাদের পক্ষে কঠিন কিছু নয়। যতদূর জানি, রাসায়নিকের গুদাম সরানো হয়নি। এখন ঢাকা নগরী চারদিকে বিস্তৃত হচ্ছে এবং এসব এলাকার সঙ্গে ঢাকার সড়ক যোগাযোগও স্থাপন করা হয়েছে। মূল ঢাকার একটু দূরে হালকা বসতি এলাকায় এ ধরনের রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নিলে বিপদের আশঙ্কা অনেকটাই হ্রাস পাবে। শুধু তাই নয়; কী করে গুদামঘরে গ্যাসের সিলিন্ডারগুলো রাখা এবং ক্রটিযুক্ত সিলিন্ডারগুলো ব্যবহার থেকে সরিয়ে রাখা যায়, তা এ ব্যবসার মালিকরা ভালো করেই বোঝেন।

সাময়িকভাবে একটু লাভের জন্য যদি ব্যবসার ব্যবস্থাপনার দিকগুলো দুর্বল অথবা ত্রুটিযুক্ত থাকে, তাহলে যে কোনো সময় বিপদ ঘটতে পারে এবং ঘটনাচক্রে ব্যবসাটির মালিক বা তার আপনজনও দুর্ঘটনাকবলিত হতে পারেন। এই বুঝটুকু তাঁদের থাকা উচিত।

সর্বশেষ তিনটি দুর্ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছেন, ঘটনাস্থলে দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে এমন কোনো বস্তু সেখানে রাখা হয়নি। মোটামুটি তাঁদের সবাই এখন পর্যন্ত একমত– গ্যাস জমে এবং ভারী হয়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে। তবে যে কোনো বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকই বলবেন, ঘটনাগুলো নিয়ে গভীর অনুসন্ধান ও তদন্ত হওয়া উচিত। আমাদের অবশ্যই তদন্ত বা রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে অপেক্ষা যেন অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বের মধ্যে পড়ে না যায়।

এখন দেখছি, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজেই বিশেষজ্ঞ হয়ে ঘটনার কারণ সম্পর্কে একটি থিউরি দিয়েছেন। থিউরিটি হলো– বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে নাশকতা করতে পারে। প্রশ্ন হলো, গত কিছুদিনে বিএনপি যেসব সভা-সমাবেশ করেছে, সেগুলো ঠিক আন্দোলন নয়; আন্দোলনের ওয়ার্মআপ মাত্র। কাজেই আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই সময় হঠাৎ ওবায়দুল কাদের যা বললেন, তা দুর্ঘটনার তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে। দেখা যাবে, তদন্তকারীরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যকে সঠিক প্রমাণের জন্য তদন্ত অনুষ্ঠানের প্রটোকলটি পাল্টিয়ে দেবেন।

আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিশেষ করে যাঁরা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত; তাঁরা অনেক সময় দায়িত্বহীনভাবে যেসব উক্তি করেন, তার কারণে সত্য উদ্ঘাটন বাধাগ্রস্ত হয়। এ ধরনের ঘটনার পর সব পক্ষকেই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সঠিক কারণটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় খুঁজে বের করার মধ্যেই রয়েছে সমাধান। তবে এ ধরনের বিপজ্জনক ঘটনা ঘটার পর সরকারকে পুরো বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। এ রকম বিপজ্জনক ঘটনা ঘটতে দেওয়া যায় না। এর প্রতি উদাসীন থেকে নীরবতা পালনও কাজের কথা নয়। রাজনীতিতে ব্লেম গেম খুবই ক্ষতিকর। একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকলে মূল বিষয়টি বিবেচনার বাইরেই চলে যায়। এমন উক্তি করা উচিত নয়, যার ফলে সত্য উদ্ঘাটনের কাজটি দুরূহ হয়ে ওঠে।

ড. মাহবুব উল্লাহ: অর্থনীতিবিদ; প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়