
সন্দেহ নেই– প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হলে প্রায় ১০ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়ার হাত ধরে দলটি ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। এবার দলটি প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে।
বিএনপি এই দফায় সংকটে পড়ে মূলত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার পর। আলোচিত-সমালোচিত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে তারেক রহমানের আটক হওয়া, দীর্ঘদিন কারাভোগের পর চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া এবং লন্ডনে অবস্থানের ফলে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে বিপক্ষ শিবিরের প্রশ্ন বরাবরই ছিল। তবে বিরোধীদের এই প্রশ্নের মোক্ষম জবাব দেখা গেছে গত বছরের মধ্য জুলাই থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনে। সেই ধারাবাহিকতায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন এবং ঢাকার ১০ ডিসেম্বরের আগে বিএনপির নেতৃত্বের একটি ইঙ্গিত সম্ভবত পাওয়া গিয়েছিল। আর কেউ না হোক; সরকার বা ক্ষমতাসীন দল নিশ্চিতভাবেই পেয়েছিল। তাই ১০ দফা দাবিতে ঢাকার গণসমাবেশের আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে।
দলের চেয়ারপারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দু’জন সরাসরি মাঠের রাজনীতিতে না থাকায় শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে বিপক্ষের রাজনৈতিক শিবির থেকে প্রায়ই নানা কথা শোনা যায়। গত নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পরও এই আলোচনা সামনে এসেছিল। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ক্ষমতায় এলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী– এর কোনো উত্তর এখনও দলটি প্রকাশ্যে আনেনি। বিএনপি জয়ী হলে সরকারপ্রধান কে হবেন– এই ইস্যুটি নিয়ে কানাঘুষা চললেও বিএনপি এখনও তা সামনে আনছে না বলেই দেখা যাচ্ছে। কৌশলগত কারণের দোহাই দিয়ে বিএনপি যদি এবারও আগাম ঘোষণা দিতে না পারে, তাহলে বিরোধী শিবিরের কথাই সত্য হয়ে সামনে হাজির হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে আগামী দিনের আন্দোলনে এর কী প্রভাব পড়বে, সেটাও ভেবে দেখতে হবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির চলমান আন্দোলনকে বলেছেন, ‘গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন।’ বিএনপি মহাসচিব যে আন্দোলনের কথা বলছেন, তার একটি রূপরেখাও ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। সেই রূপরেখা বাস্তবায়নে বিএনপি কাজ করছে বলেও দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। আবার বিএনপির প্রধান বিরোধী শক্তি বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতারাও বলে আসছেন– বিএনপির নেতৃত্বে সংকট রয়েছে। নেতৃত্বের সংকট নিয়ে ক্ষমতায় এলে বিএনপি কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে? আওয়ামী লীগের এই বক্তব্য রাজনৈতিক ধরে নিলেও বিএনপির কাছ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর আমরা জানতে চাই। নইলে বিরোধীদের কাছে যেখানে সামান্য কথার লড়াইয়ে কেউ হারতে চায় না, সেখানে নেতৃত্বের মতো বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যাবে কেন?
সোভিয়েত নেতা লেনিনের মৃত্যুর পর কে হবেন তাঁর উত্তরাধিকারী– তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। লেনিনের দুই সহযোদ্ধা স্ট্যালিন ও ট্রটস্কি একে অপরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হন সেই সময়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে নেতৃত্ব দিতে স্ট্যালিনের পাশাপাশি আরও আগ্রহী ছিলেন লিয়ন ট্রটস্কি, গ্রিগরি জিনোভিয়েভ, লেভ কামেনেভ, নিকোলাই বুখারিন, অ্যালেপি রাইকভ, মিখাইল টমস্কি প্রমুখ। এরা সবাই সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়ে লেনিনের উত্তরসূরি হতে চেয়েছিলেন। এর ফলেই রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়েছিল।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা এখন প্রায়ই বক্তব্য-বিবৃতিতে বলে থাকেন, দেশে আগামীতে একটি বিপ্লব ঘটাতে হবে। তারপর জনতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শাসন পদ্ধতি নির্ধারিত হবে। আমরা যদিও জানি যে, বিএনপি কোনো বিপ্লবী দল নয়। বিপ্লব করা বিএনপির কাজও নয়। তবুও দলটির নেতারা বিপ্লবের কথা বলছেন। আমরা ধরে নিতে চাই, এটা তারা বর্তমান অবস্থা থেকে পরিবর্তনের জন্যই বলছেন। সেটিও যদি হয়, তাহলেও তাদের আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য একজন নেতাকে সামনে রাখতে হবে। লেনিনের মৃত্যুর পর পার্টি একক নেতৃত্বের পরিবর্তে যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া উচিত– এমন মতামত এসেছিল সেই সময়ে। তবে শেষে তা হয়নি। পরে ট্রটস্কির তুলনায় স্ট্যালিনকে নিরাপদ বিবেচনা করা হয়েছিল। স্ট্যালিন দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিজের ভিত্তি মজবুত করেছিলেন। নিজের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য করে তুলেছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে সুপ্রিম লিডার হয়ে ওঠেন স্ট্যালিন।
এখন খালেদা জিয়া নির্বাচন থেকে দূরে থাকলে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে থাকা অবস্থায় বিএনপির সামনে এমন একজনকে দাঁড় করাতে হবে। দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং টানা সর্বোচ্চ সময়ের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হতে পারেন সেই ব্যক্তি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চর্চা, তাতে মির্জা ফখরুলের চেয়ে দ্রুত কার্যকর কাউকে শিগগিরই খুঁজে নেওয়া বিএনপির জন্য সহজ বলে মনে হচ্ছে না।
এহ্সান মাহমুদ : সহ-সম্পাদক, সমকাল
মন্তব্য করুন