আজ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উদ্যোগে মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তার স্বার্থে চারটি অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির ঐতিহাসিক দিনটি স্মরণে প্রতিবছর ১৫ মার্চ পালিত হয় বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে জাতিসংঘ ভোক্তা অধিকার রক্ষার নীতিমালায় কেনেডি বর্ণিত চারটি মৌলিক অধিকারকে বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরও আটটি মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করা হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘নিরাপদ জ্বালানি, ভোক্তাবান্ধব পৃথিবী’।

বাজার ব্যবস্থার প্রধান দুটি দিক ক্রেতা ও বিক্রেতা। যদিও যিনি ক্রেতা তিনি ভোক্তা না-ও হতে পারেন; তবে ধরা হয় ভোগের উদ্দেশ্যেই তিনি ক্রয় করেন। অর্থাৎ তিনিই ভোক্তা। একজন ভোক্তা হিসেবে ক্রেতার যেসব অধিকার, তা আমাদের দেশে খুব কম মানুষই জানে। সে জন্য একদিকে যেমন অসাধু ব্যবসায়ী লাভবান হয়, তেমনি বাজার ব্যবস্থাও প্রভাবিত হয়। একজন ক্রেতার সঙ্গে ভোক্তার সম্পর্ক হবে আন্তরিক ও বিশ্বস্ততাপূর্ণ। অর্থাৎ নির্ধারিত মূল্যের বিনিময়ে ভোক্তা যে পণ্যটি কিনবে, তা কিনে যেন প্রতারিত না হয়। যদি এভাবে সম্পর্ক এগিয়ে যায় তাহলে উভয়ের ভেতর হৃদ্য বৃদ্ধি পাবে।

প্রায়ই দেখা যায় প্রতিশ্রুত সেবা প্রদানে অবহেলা, দায়িত্বহীনতা বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সঠিক সেবা না দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। একজন চিকিৎসক কিংবা অন্য কোনো সেবাদাতা সঠিক সেবা না দেওয়ার কারণে তার লজ্জা পাওয়া কিংবা ক্ষমা চাওয়া উচিত। তা না করে বিপরীত ঘটনা ঘটছে। এগুলো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সর্বত্রই আমরা নকল-ভেজাল দেখতে পাই। কৃষিজমিতে ভেজাল, করোনা টেস্টের ফলে ভেজাল, রাজনীতিতে ভেজাল, নেতায় ভেজাল, খেলার মাঠে ভেজাল, শিল্পী সমিতিতে ভেজাল, বিচারের ক্ষেত্রে ভেজাল, শিক্ষায় ভেজাল, চিকিৎসায় ভেজাল (অবহেলায় রোগীর মৃত্যু)। এই ভেজালের ভিড়ে নিরাপদ কিংবা স্বাস্থ্যকর খাদ্য পাওয়া কতটা সম্ভব? তবে ভেজালমুক্ত পণ্যই আমরা চাই। অসচেতন ভোক্তার নীরবতা ও নির্লিপ্ততায় অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যপণ্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে খাবারকে বিষে পরিণত করে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ কোটি লোক খাদ্যজনিত বিষক্রিয়ায় ভুগছে। রাজধানী ঢাকার ৫০-৬০ শতাংশ সবজিতেই বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানো। ঢাকা সিটি করপোরেশন রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে ৭৬টি খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে; যার চার ভাগের তিন ভাগ নমুনায় ভেজাল পায়। সারাদেশে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কোম্পানি ২৪৬টি, আয়ুর্বেদিক কোম্পানি ২২৪টি, ইউনানি কোম্পানি ২৯৫টি, হোমিওপ্যাথিক প্রতিষ্ঠান ৭৭টিসহ মোট ৮৪২টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট তৈরি করছে ১০৬টি প্রতিষ্ঠান। ৪০ থেকে ৫০টি ছাড়া বাকি কোম্পানিগুলো নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, নকল ও ভেজাল ওষুধের বেশিরভাগের মধ্যেই কোনো কেমিক্যাল উপাদান নেই। ময়দা দিয়ে তৈরি করা হয় এসব ওষুধ।

আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য না বাড়লেও দেশীয় বাজারে কালোবাজারি, মজুতদারির মাধ্যমে লবণ, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশে এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। রমজান মাস ইবাদতের মাস। পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশে রমজান মাস উপলক্ষে দ্রব্যমূল্য কমানো হয়। অথচ আমাদের দেশে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে রমজান মাসকে উপলক্ষ করে সবজি, ফলমূল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়, যা ভোক্তা হিসেবে পরিতাপের বিষয়। সত্যিই আমরা অবৈধ সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে অসহায় জীবন যাপন করছি।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বাজারে পরিলক্ষিত বিষয় হচ্ছে, সরকার যেখানে সয়াবিন তেলের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেখানে আমাদের অতিরিক্ত দামে কিনতে দোকানদাররা অনেকটা বাধ্য করছে। নির্ধারিত দামে পণ্য কিনতে চাইলে দোকানদার বলে– পণ্য নেই। অথচ তারা অতিরিক্ত মুনাফার উদ্দেশ্যে বাজারে পণ্যের সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। এ অবস্থায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত লোকেরা টিসিবির গাড়ির পেছনে ছুটেও কাঙ্ক্ষিত পণ্য পাচ্ছে না। কেউ কেউ অদূর ভবিষ্যতে বা সামনে রমজান উপলক্ষে আরও মূল্য বেড়ে যাওয়ার ভয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য বাসায় মজুত করে রাখছে। এতে জোগান ও চাহিদার ভারসাম্যহীনতার কারণে অনেকেই অর্থ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পণ্য পেতে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে। তাই এসব কাজে আমাদের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।

ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ ও তাদের অধিকার রক্ষায় একটি কার্যকর আইন প্রণয়নের দাবি দীর্ঘ দিনের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন। আইনটি প্রণয়নের ফলে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ভোক্তা তথা জনগণ এর সুফল পেতে শুরু করেছে। আগে যেখানে অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যেই পণ্যে ভেজাল মেশাত; আজ সেখানে কিছুটা হলেও রাখঢাক করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ভোক্তা অধিকার আইন প্রণয়নের ১৩ বছর পরও আইনি দুর্বলতা ও প্রচারের অভাবে কাঙ্ক্ষিত সুফল মিলছে না। ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কোথায় কীভাবে অভিযোগ করতে হবে; এ সম্পর্কে জানা না থাকার কারণে ভোক্তারা অধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে অভিযোগ করতে পারছে না।

সম্প্রতি বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতি, ডিজিটাল আর্থিক খাতে প্রতারণা, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণা, অনলাইনে অবৈধভাবে ঋণদানের নামে প্রতারণা, ই-টিকিটিংয়ের ক্ষেত্রে মনগড়া সার্ভিস চার্জ আদায় এরই প্রমাণ। এ অবস্থায় ই-কমার্স সেবা, অনলাইন রাইড শেয়ারিং, অনলাইন ফুড ডেলিভারি সিস্টেম, ই-টিকিটিং, বিভিন্ন সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট ও অ্যাপের ক্রেতা, অনলাইনে বিভিন্ন সেবার গ্রাহক, মোবাইল ব্যাংকিং খাতের গ্রাহক ও টেলিকম সেক্টরের ভোক্তাদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে আইনের মাধ্যমে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি।

ভোক্তা অধিকার উন্নত বিশ্বে বহু দূর এগিয়েছে। তারা নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আমি, আপনি, আমাদের সন্তান– সবাই একেকজন ভোক্তা। প্রত্যেকের নিজের অধিকার নিয়ে সচেতন হওয়ার অধিকার রয়েছে। কেউ সেবার নামে প্রতারণার আশ্রয় নিলে অভিযোগ করার আইনগত অধিকার সবার। আমরা যদি প্রতিবাদ না করি তাহলে ভোক্তা অধিকার বিষয়টি অন্তরালেই থেকে যাবে। এ দিবসে আমরা সেখানেই জোর দিতে চাই।

শেখ মাজেদুল হক : সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

smh.mkt@brur@ac.bd