অতি সম্প্রতি আমেরিকার দুটো ব্যাংকের ‘কলাপস’ পতন হয়েছে। একটি সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি), অন্যটি সিগনেচার ব্যাংক। আমেরিকায় ব্যাংকে লালবাতি জ্বলা বা ব্যাংক ধসে পড়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি) থেকে জানা যায়, ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ৪৬৫টি ব্যর্থ ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশেষত ২০০৮ সালে কয়েকটি বড় ব্যাংকের পতন হলে বেইল আউট করতে এগিয়ে এসেছিল ওবামা প্রশাসন।

এসভিপি ও সিগনেচার অবশ্য আঞ্চলিক ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে স্থাপিত এসভিবি ব্যাংক আমেরিকার প্রায় অর্ধেক ভেঞ্চার প্রদত্ত প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কোম্পানিগুলোর অর্থসংস্থানের বড় উৎস ছিল। প্রযুক্তি শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ছাড়াও ইদানীং স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোকে অর্থ দিত এ ব্যাংক। সিলিকন ভ্যালির বাইরে কম পরিচিত হলেও এটি আমেরিকার ‘টপ টোয়েন্টি’ ব্যাংকের একটি এবং মোট সম্পদের পরিমাণ ২০৮ বিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি ব্যাংকটির অবস্থা বেগতিক দেখে আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষায় নিয়ন্ত্রকরা এগুলো দখলে নিয়েছেন, তবে ২০০৮ সালের মতো বেইল আউট দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে নয়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন স্পষ্ট বলেছেন, তাঁর সরকার আমানতকারীদের সুরক্ষা দেবেন; বিনিয়োগকারীদের নয়। কারণ মুনাফার জন্য তাঁরা ঝুঁকি নিয়েছেন এবং এটিই পুঁজিবাদের আসল কথা।

মূলত দুটো কারণে এসভিবি ধরাশায়ী। প্রথমত, ব্যাংকটি দীর্ঘকালীন সম্পদে বিনিয়োগ করেছে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। হাতে নগদ অর্থ বা তারল্য ছিল কম। ফলে অনেকে ব্যাংকে এসে টাকা পাননি এবং আতঙ্কের সূত্রপাত ওখান থেকেই। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ফেডারেল রিজার্ভের আগ্রাসী অত্যন্ত চড়া সুদ নীতি পতনের গায়ে হাওয়া দিয়েছে। এসভিবি যে বিপুল পরিমাণ বন্ড কিনে রেখেছিল, তাতে মার খেয়েছে। তার কারণ উচ্চ সুদ আর বন্ডের দামের সম্পর্ক বিপরীতমুখী। যখন ঘোষণা এলো যে, দেনা মেটানোর জন্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ব্যাংকের সম্পদ বিক্রি করা হয়েছে, তার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পতন ঘটল। পর্যালোচনায় বেরিয়ে আসছে, অতিলোভের কারণে ব্যাংকটি বখাটে থেকে পতনের সিঁড়িতে পা দিয়েছে। অনেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দোষ দিয়ে প্রশ্ন রাখছেন, তারা এতদিন কোথায় ছিল? এমনকি আমেরিকার আর্থিক ব্যবস্থাপনার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঠিকমতো কাজ করছে না বলেই এ অবস্থা।

দুই.

বাংলাদেশের অবস্থা অবশ্য ভিন্ন। এখানে সমস্যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগ্রাসী সুদনীতি নয়; যেমন নয় ঋণের ক্ষেত্রে বিশেষ খাতের প্রাধান্য। তাই বলে বখাটে ব্যাংকের সংখ্যা একেবারেই কম নয়। বর্তমানে প্রায় ৬০টি ব্যাংক কাজ করছে এবং শোনা কথা, ডজনখানেক রয়েছে অনুমোদনের অপেক্ষায়। বলা বাহুল্য, যারা অনুমোদন পাচ্ছে তাদের প্রায় সবাই সরকার সমর্থক। অথচ রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত ব্যাংক যে কত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তার বড় প্রমাণ কিছুকাল আগে ঘটে যাওয়া ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি। সোনালী, বেসিক, জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারি শেষে নিয়ন্ত্রকদের ঘুমে রেখে মাথা তুলেছিল ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি। এসব ঘটছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখের সামনে। অথচ এরা অর্থবাজারের অভিভাবক।

অবশ্য ইদানীং বাংলাদেশের ব্যাংকিং বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কথাই যেন সরকার শুনতে আগ্রহী নয়। কথা হচ্ছে, অর্থ মন্ত্রণালয় যদি ব্যাংক খাতের সব দেখাশোনা করতে পারে তাহলে আলাদা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাখার কোনো যুক্তি আছে কি? এটাও ঠিক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সরকারের কাছে ‘গুড বয়’ ইমেজ রক্ষা করতে গিয়ে বাজারবহির্ভূত অসংগতিগুলো গিলতে বাধ্য হচ্ছে। আর সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় যা করছে, তা অর্থনৈতিক বিবেচনাপুষ্ট নয়।

বস্তুত দেশের কোনো কোনো ব্যাংকের অবস্থা বখে যাওয়া ‌ছোকরার মতো, যে প্রতিবার টাকা আকাশে উড়িয়ে আবার বাবার কাছে হাত পাতে। পার্থক্য এটুকুই, বখাটে ছেলেকে বাবা তাঁর পকেট থেকে টাকা দেয়; আর বখে যাওয়া ব্যাংকগুলোকে সরকার অর্থ দেয় জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে। কেউ কেউ কিছুকাল আগে ভারতে ১৪ বিলিয়ন ডলারের পুঁজি পুনঃকরণ প্রসঙ্গ টেনে আনেন। এতে স্পষ্ট হয়, আমরা ভালো ভালো দীক্ষা নিতে দুঃখ পাই, অথচ মন্দ উদাহরণ টেনে মহা আনন্দে থাকি। ভারতে ঋণ খেলাপের প্রধান কারণ আমলাতান্ত্রিক ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে মেগা প্রকল্প শেষ হতে দেরি হওয়া এবং এর ফলে বিনিয়োগকারীর আর্থিক ক্ষতি। অন্যদিকে বাংলাদেশে ঋণখেলাপির কোনো প্রকল্পই থাকে না। যা থাকে, তা মিথ্যা প্রকল্প, মিথ্যা দলিল। তা ছাড়া ভারতে পুঁজি পুনঃকরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বহুমাত্রিক সংস্কার সাধনের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে তা হয় না, বরং চোখ বুজে পুঁজি পুনঃকরণ করা হয়ে থাকে।

বেসিক ব্যাংকের ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার জন্য ওই ব্যাংকের বোর্ডের কোনো সদস্যকে জেল খাটতে ও জরিমানা গুনতে হয়নি। এদিকে একই ব্যক্তির বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্পে জনতা ব্যাংক অর্থ ঢেলেছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। অথচ এর বোর্ড সদস্য বা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কোনো মামলা এ পর্যন্ত রুজু করা হয়নি। সোনালী ও অন্যান্য ব্যাংকের কথা না হয় না-ই তোলা হলো।  

কেন্দ্রীয় তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনা দরকার। উন্নয়ন চেতনা, আর্থিক জগতে ইনোভেটিভ ও নীতি বাস্তবায়নে অধিকতর কঠোর হওয়া প্রয়োজন। সরকারের উচিত হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন দেওয়া। পুরো আর্থিক বাজারের উন্নতি ও অবনতির দায়ভার বাংলাদেশ ব্যাংকের। সরকার তার কর্তব্য পালনে সহায়তা করবে মাত্র।

শেষ কথা– দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। এত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থাকার প্রয়োজন আছে কি নেই, তা এখন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। প্রয়োজন থেকে থাকলেও ওগুলো শুধু ডিপোজিট সংগ্রহে কাজে লাগানো যায় কিনা, সেটিও ভাবার বিষয়। মোট কথা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর, এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈপ্লবিক সংস্কার না ঘটা পর্যন্ত রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে বলে মনে হয় না। একমাত্র ব্যাপক সংস্কার সাপেক্ষে রুগ্‌ণ কোনো ব্যাংকের জন্য সীমিত মাত্রায় পুনঃপুঁজিকরণ হতে পারে। মনে রাখতে হবে, শর্তহীনভাবে পুনঃপুঁজিকরণ প্রক্রিয়া ব্যাংক রুগ্‌ণ হওয়ার অন্যতম উৎসাহদাতা। সুতরাং শেয়ার মার্কেটের ধসের মতো ব্যাংক খাতে যাতে সুনামি না আসতে পারে তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় পস্তাতে হবে সবাইকে।

তিন.

হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকের একটি বিখ্যাত উক্তি এ রকম: রিকশা চালিয়ে উপার্জন করলে মানুষ দেখে ফেলবে; মান-ইজ্জতের বালাই থাকবে না। তার চেয়ে অন্ধকারে চুরি করা অনেক ভালো। কেউ দেখবে না, উপার্জন হবে; মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে না। বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোতে যে হরিলুট চলছে, তাতে বহুব্রীহি নাটকের উক্তিটি বারবার মনে পড়ে। ব্যাংকের সবাইকে অন্ধকারে রেখে অন্ধকার পথে ডাকাতি করে বড় হওয়ার বাসনা বড় বড় লোকের।

অধ্যাপক আব্দুল বায়েস: প্রাক্তন উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; খণ্ডকালীন শিক্ষক, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি