- মতামত
- তিন মাসে এক বছরের সমান খেলাপি ঋণ পুনঃতপশিল
তিন মাসে এক বছরের সমান খেলাপি ঋণ পুনঃতপশিল

শর্ত শিথিলের পর ব্যাংকে খেলাপি ঋণ পুনঃতপশিল ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গত বছরের শেষ তিন মাসে পুনঃতপশিল করা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা, যা এর আগের এক বছরের সমান। বড় অঙ্কের পুনঃতপশিলের ফলে গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ১৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা কমে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা হয়েছে।
ডলার সংকটের এ সময়ে আইএমএফ থেকে সরকার যে ঋণ নিচ্ছে, তার অন্যতম শর্ত খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। তবে আদায়ে কঠোরতার পরিবর্তে পুনঃতপশিলের শর্ত শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করছে। এ ধরনের উদ্যোগ আগেও বিভিন্ন সময়ে নেওয়া হয়। এতে সাময়িকভাবে কিছু ঋণ আদায় হলেও পরে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে অনেক আগে থেকেই খেলাপি ঋণ পুনঃতপশিল করতে পারে ব্যাংকগুলো। তবে শর্ত শিথিল করে গত ১৮ জুলাই নতুন নীতিমালা জারি করা হয়। নতুন নীতিমালায় ডাউন পেমেন্টের হার কমিয়ে বকেয়ার আড়াই থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। আগে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ডাউন পেমেন্ট বা এককালীন জমা দিতে হতো। আবার আগে কোনো ঋণ একবারে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য পুনঃতপশিল করা যেত। এখন ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ প্রথম দুই দফা ৮ বছর করে ১৬ বছর, তৃতীয় দফায় ৭ বছর এবং চতুর্থ দফায় ৬ বছরের জন্য পুনঃতপশিল করা যাবে। এভাবে পুনঃতপশিলের পর নতুন ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ‘সমঝোতার অঙ্ক’ জমা দেওয়ার শর্তও শিথিল করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ তিন মাসে মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নীতিমালার আলোকে ঋণ পুনঃতপশিল হয়েছে। অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে পুনঃতপশিল হয়েছে ১৭ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ১ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করেছে ব্যাংকগুলো। এর আগের তিন মাসে ৫ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা পুনঃতপসিল করা হয়, যার বিপরীতে সুদ মওকুফের পরিমাণ ছিল ৩৫১ কোটি টাকা। আর গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে ৬ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা পুনঃতপশিল করা হয়। এর বিপরীতে সুদ মওকুফ করা হয় ১ হাজার ৫১ কোটি টাকা।
করোনার কারণে ২০২০ সালে কোনো ঋণগ্রহীতা কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাঁকে খেলাপি করা হয়নি। আর ২০২১ সালে যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা ১৫ শতাংশ দিলেও খেলাপিমুক্ত থাকা গেছে। গত বছর কিস্তির ৫০ শতাংশ দিলে খেলাপি করা হয়নি। তবে এর আগে ২০১৯ সালে মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমন্ট দিয়ে ১২ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতপশিলের সুযোগ দেওয়া হয়। ওই বছর ৫২ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনঃতপশিল হয়। তার আগে বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠন বা পুনঃতপশিল করা হয়েছে। গত দশ বছরে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে বছরের পর বছর শিথিলতা দেখানো হয়েছে। এতে কোনো কাজ হয়নি। এর আগে যারাই বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃতপশিল বা পুনর্গঠন সুবিধা নিয়েছে, পরবর্তী সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের ঋণ আবার খেলাপি হয়েছে। ফলে এখন কঠোর হওয়ার সময় এসেছে। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির কারণে এখনই কঠোর হওয়ার উপযুক্ত সময়। কেননা, তাঁরা চলতি বছরের মধ্যে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন ও নতুন কর আইন পাস করে আগামী বছর থেকে বাস্তবায়নের শর্ত দিয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে হঠাৎ জিনিসের দর বৃদ্ধির পেছনে ঋণ কুক্ষিগত হওয়া একটি বড় কারণ। কেননা একই গোষ্ঠীর কাছে বছরের পর বছর ঋণ আটকে থাকায় নতুন ব্যবসায়য়ীরা সামনে আসতে পারছেন না। ফলে তাঁরা রাতারাতি জিনিসের দর বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এ অবস্থার উন্নতি করতে হলে অবশ্যই কঠোর হতে হবে।
ডলার সংকট কাটাতে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের প্রথম কিস্তি পেয়েছে বাংলাদেশ। আরও ৬ কিস্তিতে বাকি অর্থ ছাড় হবে। প্রতি পর্যায়ে বিভিন্ন শর্ত পরিপালন দেখে ঋণ ছাড় করবে সংস্থাটি। আইএমএফ ঋণের অন্যতম শর্ত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি ব্যাংকের ৫ শতাংশের নিচে নামাতে হবে।
মন্তব্য করুন