- মতামত
- বঙ্গবন্ধু ও জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়
বঙ্গবন্ধু ও জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়

বাঙালির জন্য জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় হঠাৎ করে হয়নি। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে একজন নেতার স্বপ্ন ও দূরদর্শী চিন্তা। সেই নেতা হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উপলব্ধি ও দূরদর্শী চিন্তা থেকে জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ২৪ বছর আগে বাংলার স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনি।
তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের মধ্যে বাংলার মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার চিন্তা উদ্ভবের কারণ প্রধানত দুটি। প্রথমত, মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি; দ্বিতীয়ত, অসম প্রক্রিয়ায় ভারতবর্ষের বিভাজন। ভারতবর্ষ ভাগের আগেই তিনি মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক ও সুবিধাবাদী রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, মুসলিম লীগের সঙ্গে থেকে বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতবর্ষ ভাগের পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। কারণ শুধু কেন্দ্রীয় কংগ্রেসই নয়, কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগও মাউন্টব্যাটেনের ফর্মুলায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তানের বিভক্তি মেনে নেয়। এই ভাগের ফর্মুলায় বাংলার অসম বিভাজন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবসহ বাংলার নেতারা মেনে নিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে (পৃষ্ঠা ৭৩) লিখেছেন, ‘বাংলা যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না। সমস্ত বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল তাদের ধারণা।’
মাউন্টব্যাটেনের ফর্মুলা ঘোষণার পর কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের সিরাজোদ্দৌলা হোস্টেলে ছাত্র ও যুবনেতাদের নিয়ে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে লীগ বিরোধী ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভারতবর্ষ ভাগের ব্যাপারে শেখ মুজিবের উপলব্ধি সম্পর্কে স্পষ্টত লেখা রয়েছে আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত মযহারুল ইসলামের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৯৪)। তিনি লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতায় সিরাজোদ্দৌলা হলে বন্ধু সহকর্মীদের ডেকে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান হতে যাচ্ছে, এই স্বাধীনতা সত্যিকারের স্বাধীনতা নয়। হয়তো বাংলার মাটিতে নতুন করে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু যে ওই সময়েই বাংলার স্বাধীনতার কথা ভেবেছিলেন, তা আরও জানা যায় স্বাধীনতা-উত্তর প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদা শঙ্কর রায়ের বঙ্গবন্ধুকে করা প্রশ্নের উত্তর থেকে। বঙ্গবন্ধুকে শ্রী শঙ্করের প্রশ্ন ছিল, ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’ উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালে। তখন আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে।’ (ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু, প্রকাশক : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ)।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর শেখ মুজিব ঢাকা এসে প্রগতিশীল ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমেদ, তাজউদ্দীন আহমদ, তসাদ্দক আহমেদ প্রমুখের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গঠিত হয় লীগ বিরোধী অসাম্প্রদায়িক সংগঠন পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ। লক্ষণীয় যে, যুবলীগ নবগঠিত পাকিস্তানের গণতন্ত্র, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও ভাষা বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবে বলা হয়, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বাংলা ভাষা প্রশ্নে এমন প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, যাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিব।
পাকিস্তান স্বাধীন হলেও তা যে বাঙালির হবে না তরুণ ছাত্রনেতা মুজিবের এমন উপলব্ধিই সত্য হলো মাত্র আট মাসের মধ্যে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই মুসলিম লীগ ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জিন্নাহর স্বরূপটিও সহসাই উন্মোচিত হয়। মোট জনসংখ্যার ৫৪ দশমিক ৬ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলার পরিবর্তে মাত্র ৭ দশমিক ২ ভাগ মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন তিনি। এ ঘোষণার প্রতিবাদে বাঙালিরা রাজপথে নামে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবিতে আন্দোলনে শেখ মুজিব সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানে তাঁর প্রথম গ্রেপ্তার ছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সচিবালয়ের সামনে ধর্মঘট পালনকালে। ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনশন ধর্মঘটের ঘোষণা এবং জেল থেকে আন্দোলনকারী ছাত্র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়ে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহমেদকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়।
বঙ্গবন্ধু এক দিনের জন্যও পাকিস্তান কথাটি মেনে নিতে পারেননি। তিনি বলতেন পূর্ব বাংলা, বাংলা। পাকিস্তান গণপরিষদের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, “স্যার, আপনি দেখবেন, ওরা পূর্ব বাংলা নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে আপনারা এটাকে বাংলা ডাকেন। বাংলা শব্দটার একটা ইতিহাস আছে, আছে ঐতিহ্য।”
বঙ্গবন্ধু হৃদয়ে ধারণ করতেন বাংলাদেশকে। তাঁর আন্দোলন-সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল– বাংলার মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা। তিনি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে গণতন্ত্র, শোষণ-বৈষম্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, ছয় দফা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি যোগ করে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করেন। ২৩ বছরের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে বাংলার রাজপথ রঞ্জিত হলেও বঙ্গবন্ধু আন্দোলন করেছেন গণতান্ত্রিক ধারায়। এটি ছিল তাঁর কৌশল। রাজনীতি ও আন্দোলনে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু আন্দোলনকে স্বাধীনতা সংগ্রামে পৌঁছে দেন। কী ছিল সেই কৌশল? গভীর বিশ্লেষণে দেখা যায়, গণতান্ত্রিক ধারায় আন্দোলন পরিচালনা কৌশল গ্রহণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু তিনটি অধিকার অর্জন করেন, যা বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনের পথ সুগম করে। প্রথমত, রাজনৈতিক অধিকার। পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী নানা অজুহাতে বাঙালির রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছে। মার্শাল ল’ জারি করে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধও করেছে বারবার। বঙ্গবন্ধু আন্দোলনকে সহিংস রূপ নিতে দেননি। যে কারণে পাকিস্তানি শাসকরা কখনোই এ আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে অভিহিত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একে সহিংস বা সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারেনি। গণতান্ত্রিক ধারায় আন্দোলন করেই তিনি রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, দেশ শাসনের সাংবিধানিক অধিকার। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সাংবিধানিক অধিকার অর্জন করে। ৩০০ আসনের গণপরিষদে জনসংখ্যার অনুপাতে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ আর পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩১ আসনের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপলস পার্টি পায় ৮১টি আসন। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনকে আন্দোলনের কৌশল হিসেবে বেছে নেন। যে কারণে ওয়েস্টমিনস্টার টাইপের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়েও সামরিক সরকারের জারি করা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) অধীনে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনী প্রচার চলাকালে এক পাকিস্তানি সংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব বলেন, নির্বাচনের পরে ওই এলএফও আমি ছিঁড়ে ফেলব। তৃতীয়ত, নৈতিক অধিকার। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগেরs নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয় লাভের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সংসদের অধিবেশন আহ্বান করেও তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ও ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করলে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তারের আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার নৈতিক ও আইনগত অধিকার ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই, যা তিনি সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমেই অর্জন করেন। কোনো ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে কারও এই স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার এককভাবেই ছিল বঙ্গবন্ধুর।
বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতাই ছিল বঙ্গবন্ধুর ধ্যানজ্ঞান। এই মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য জীবনের ১৩ বছরেরও বেশি সময় তিনি কাটিয়েছেন কারাগারে। ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলার আনাচে-কানাচে। তাঁর নেতৃত্বে ২৩ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালের মার্চে এসে সশস্ত্র রূপ লাভ করে। তাঁর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। ৯ মাসের রক্তস্নাত যুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান এবং দুই লাখ মা-বোনের সর্বোচ্চ ত্যাগের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ তথা বাঙালির জন্য জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
মন্তব্য করুন