
১৮২০ সাল ছিল এই উপমহাদেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ, ওই বছরে জন্মেছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঠিক তার এক শতাব্দী পর ১৯২০ সালে জন্মালেন আরেক মহাপুরুষ, বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।
তারিখ ১৭ মার্চ, ১৯২০। গোপালগঞ্জ জেলার এক নিভৃত পল্লীগ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় ওই বছরই জন্মেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সুজলা-সুফলা বাইগার নদীর জলবিধৌত এই ভূমিতে বিখ্যাত শেখ পরিবারে জন্ম হয়েছিল ছোট্ট খোকার। তারপর বহুকাল আর জলের স্রোত বয়ে গেছে বাইগার নদীর বুক চিরে। বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের ছোট্ট খোকা কালক্রমে হয়ে উঠলেন সাহসী উত্তরদাতা মুজিব। হলেন সবার প্রিয় শেখ সাহেব, জাতির দুর্যোগের দিনে বঙ্গবন্ধু, আর বিশ্ববাসীর কাছে হলেন বিশ্ববন্ধু।
জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতেই বঙ্গবন্ধুর জীবনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। কারাগারে পার করেছেন অনেকগুলো জন্মতিথি। সারাজীবন ধরে ‘Honesty of Purpose’ ‘Sinciarity of Purpose’ অনুসারী এই ব্রতচারী নিজের জীবনের এই বিশেষ দিনটি নিয়ে ১৯৬৭ সালে তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচায়’ লিখেছেন, ‘আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনদিন নিজে পালন করি নাই-বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটিতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দী আছি বলেই।’
বঙ্গবন্ধু-তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার জন্মদিন প্রসঙ্গে বলেন, ‘জন্মদিন উদযাপন আব্বা কোনোদিনও পছন্দ করেন না। আব্বা বলেন, যে দেশের মানুষকে জন্মলগ্ন থেকেই সংগ্রাম করতে হয় মৃত্যুর সঙ্গে। প্রতিদিনই তো তাঁদের জন্মদিন। বিশেষ একদিন অথবা ক্ষণেকের বৈশিষ্ট্য মাপার মতো সময় বা অবস্থা তাঁদের কোথায়।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন– ‘... বিশেষ এই দিনে খুব ভোর থেকেই চেনা-অচেনা মানুষে ভরে যায় আমাদের বাসার আশপাশের রাস্তাঘাট। ওরা দুই হাত ভরে নিয়ে আসে ফুল। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ভরা থাকে ওদের মুখ। হাজার মানুষের সঙ্গে আব্বাকেও কেমন জানি খুব ভালো লাগে আমার এই দিনটিতে।’ বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা বলেন, ‘আব্বা মনেপ্রাণে বাঙালি। বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে মেশানো প্রতিটি জিনিসকে আব্বা যেমন পছন্দ করেন তেমনি বিদেশি কোনো আচার অনুষ্ঠানকে আব্বা এড়িয়ে চলেন। আব্বা বলেন, জন্মদিন শব্দটার সঙ্গে কেমন যেন বিদেশি ছোঁয়া লাগানো। আমাদের বাসাতে তাই কোনো জন্মদিনের উৎসব হয় না। শুধু আব্বার জন্মদিনের প্রত্যেক প্রভাতে বাগানের তাজা একটা ফুল তাঁকে আমি উপহার দিই।’ বেগম মুজিবের স্মৃতিচারণে আমরা শুনি, ‘পরিবারের সকলের জন্মদিনেই মিলাদ পড়ানো আমার অভ্যাস। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনেও আমি মিলাদ পড়াই। এবারও মিলাদ পড়াবো। বঙ্গবন্ধু যখন আমাদের মাঝে থাকেন, তাঁর জন্মদিনে কোনো উৎসব হয় না বাসাতে। কিন্তু যে কয়টা জন্মদিন তিনি জেলে কাটিয়েছেন সেই মুহূর্তগুলোতে বিশেষ এই দিনটাকে আমাদের সকলের বেশি করে মনে পড়েছে। তাই এই তারিখটাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চেয়ে অনেক আগ থেকেই জেল কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিতাম। একবার কী দুবার হুকুমও পেয়েছিলাম। দেখা করার সময় তাই নিয়ে গিয়েছিলাম ফুল, কিছু মিষ্টি আর গোটা কয়েক বই ও সামান্য কটা জিনিস। তবুও সহজে ছাড়পত্র পাইনি। অনেক কষ্টে যখন উপস্থিত হয়েছি তাঁর সামনে, ফুলগুলোর দিকে চেয়ে ভালো লাগার আমেজে চিকচিক করে উঠেছে তাঁর উজ্জ্বল চোখের তারা। নীরবে তাঁকে জন্মদিনের শুভকামনা জানিয়ে ফিরে এসেছি আমরা।’
বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের সঙ্গে এরূপ অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাঁর পরিবারের যার বেশির ভাগই ছিল বেদনার। তবে স্বাধীনতার পর জাতির পিতার জন্মদিনগুলো ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। কেমন ছিল সেই জন্মতিথিগুলো।
১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। সেই উত্তাল দিনগুলোতেও বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের কথা ভুলে থাকেননি। আমরা লক্ষ্য করি টুঙ্গিপাড়ার বালক খোকা পরিবারের চেয়ে প্রতিবেশীর কথা, নিজের চেয়ে সহপাঠীদের প্রয়োজন নিয়ে ভাবে বেশি। আর পরিণত বয়সে সমগ্র জাতির জন্য ভাবনা-চিন্তা। শেখ মুজিবই হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতিসত্তার এক মহান নির্মাতা। এই জন্যই বোধ হয় ইউরোপিয়ানরা বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করে থাকেন ‘ফাউন্ডিং ফাদার অব দ্য নেশন’। বাঙালি জাতিসত্তার নির্মাতা তিনিই।
১৭ মার্চ ১৯৭২ সাল তাঁর ৫৩তম জন্মতিথি। ওইদিন দৈনিক বাংলার ‘আজ উৎসব : আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন’ শিরোনামে পরিবেশনাটি ছিল এমন– ‘আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আজ তিপ্পান্নতম জন্মবার্ষিকী। তাঁর বায়ান্নতম জন্মবার্ষিকীতে কোনো উৎসব ছিল না। ব্যাকুল উত্তেজনায় পীড়িত যন্ত্রণাক্ত বাংলায় গত বছর এসেছিল ১৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধু সেদিন তাঁর জন্মবার্ষিকীতে উৎসবের দীপালি জ্বালাতে দেননি। আজ বাংলাদেশের প্রথম ১৭ই মার্চ। বঙ্গবন্ধুর তিপ্পান্নতম জন্মবার্ষিকী। ভারতের মহান নেত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর শুভ পদার্পণ ঘটছে এই দেশে আজ। দুই আনন্দের মোহনায় মিলিত হবে বাংলার উৎসবপ্রিয় জনসমুদ্র। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ময়ূরপঙ্ক্ষী নৌকায় আজ দুকণ্ঠ ভেসে আসবে। আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। আজ ইন্দিরাজী আসছেন।’ সেদিন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া তাঁর কথা রেখেছিলেন। প্রত্যাহার করেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বাধীন বাংলার এই মাটি হতে। আর এটাই ছিল তাঁর জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার।
সেদিন (১৭ মার্চ, ১৯৭২) দৈনিক বাংলার ‘উপহার : বুক ভরা ভালবাসা’ শিরোনাম আরও একটি সংবাদ ছিল এমন ‘আজ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু নিজে তাঁর জন্মতিথি পালন করেন না। গত বছর অসহযোগ আন্দোলনের চরম মুহূর্তে এইদিনে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দুঃখী বাংলার অনাহারি মানুষেরা তাদের জন্মদিনের বার্তা বোঝে না। আমিও তাই বুঝতে চাই না, কারণ আমি যে তাদেরই একজন। জাতির জনকের জন্মদিন পালন করা হচ্ছে আজ এক পরিবর্তিত পরিবেশে। রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলার মুক্ত মানুষ বুকভারা ভালবাসা দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন।’
মন্তব্য করুন