
রেমা-কালেঙ্গা থেকে রাজকান্দি হয়ে পাথারিয়া। আন্তঃসীমান্ত এই প্রাচীনসমৃদ্ধ বনগুলো নিরাপদে নেই। অগ্নিকাণ্ড কিংবা করপোরেট খননবন্দি অরণ্যের ভবিষ্যৎ। গ্যাস জরিপের নামে ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত লন্ডভন্ড হয়েছিল লাউয়াছড়া বন। অক্সিডেন্টাল, ইউনোকল, শেভরনের মতো দুনিয়া কাঁপানো কোম্পানিরা কাঁপিয়ে দিয়েছিল লাউয়াছড়া বনের নাভিমূল। গ্যাস জরিপের কারণে লাউয়াছড়ার মাগুরছড়ায় ঘটেছিল দেশের সর্ববৃহৎ ‘পরিবেশ-গণহত্যা’।
আমরা ভেবেছিলাম, বনের ভেতর করপোরেট খনন বন্ধ হবে। রাষ্ট্র প্রাকৃতিক বনে এসব অনুমোদন দেবে না। জলবায়ু বিপর্যস্ত দুনিয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে বৈশ্বিক তর্ক উঠেছে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে মুখ ফিরিয়ে নবায়নযোগ্য সবুজ জ্বালানির সম্ভাবনা দেখছে বিশ্ব। একদিকে পাতানো যুদ্ধ, আরেকদিকে মহামারির দুঃসহ ক্ষত; টালমাটাল দুনিয়া গভীরভাবে প্রাণ-প্রকৃতি আগলে বাঁচার অঙ্গীকার করছে। আর এমনই এক উতল দুনিয়ায় বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে রাজকান্দির মতো এক প্রাচীন বন ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে গ্যাস জরিপের নামে।
জানা যায়, ১৪ নম্বর ব্লকের আওতায় রাজকান্দি রেঞ্জের কুরমা, কামারছড়া ও আদমপুর বনবিট এলাকায় গ্যাস জরিপ শুরু হয়েছে এবং ধাপে ধাপে বিভিন্ন অনুসন্ধানকার্য চালাচ্ছে। সংবাদমাধ্যম সূত্র জানায়, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলার প্রায় ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় এই গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম করছে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-সিএনপিসি। পেট্টোবাংলার তত্ত্বাবধানে ও সিলেট গ্যাসফিল্ডের নির্দেশনায় এরই মধ্যে চা বাগান, চা শ্রমিক বসতি এবং হাকালুকি হাওরে ত্রিমাত্রিক জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। ত্রিমাত্রিক জরিপের সময় বিস্ফোরণ ও বিকট শব্দে বহু চা শ্রমিকের মাটির ঘরের দেয়াল ফেটে যায়। গ্যাস অনুসন্ধানে এখন বনের ভেতর ড্রিলিং করছে সিএনপিসি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, সংরক্ষিত বনে গ্যাস অনুসন্ধানে সিলেট বন বিভাগের অনাপত্তি থাকলেও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের শর্ত অনুযায়ী অনুমতিসাপেক্ষে এই ড্রিলিং চলছে।
চায়না কোম্পানিটি রাজকান্দি বনে ত্রিমাত্রিক ভূগর্ভস্থ জরিপ করবে। মন্ত্রণালয় তুলনামূলক গাছগাছালিহীন ফাঁকা স্থানে ড্রিলিং করাসহ বনের ভেতর যানবাহন প্রবেশ না করানো, গাছপালা না কাটা, প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর কার্যক্রম গ্রহণ না করা এবং বনজ সম্পদ ক্ষতি না করার শর্ত দিয়েছে। এর আগে বনের ভেতর অগ্নিকাণ্ড ঘটায় সিএনপিসি রাজকান্দি বনে আগুন লাগার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে সংবাদমাধ্যমকে জানায়, তাদের জন্য আগুন লাগেনি এবং তারা এর কারণ অনুসন্ধান করছে।
চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় ধাপে গ্যাস অনুসন্ধান কাজ শুরু হলে কোম্পানি বনের ভেতর প্রায় ২ হাজার পয়েন্ট চিহ্নিত করে সেখানকার বনতল বিনষ্ট করে গর্ত খনন করে। একটি পয়েন্ট থেকে আরেকটি পয়েন্টের দূরত্ব রাখা হয়েছে ৮০ থেকে ৯০ মিটার। এসব গর্তে প্লাস্টিক পাইপ ঢুকিয়ে রাসায়নিক বিস্ফোরক ভর্তি করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বনের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। বিস্ফোরণের অপেক্ষায় আতঙ্ক আর শঙ্কা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজকান্দি বন।
গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম কোনোভাবেই বনের সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্র এবং খাদ্যশৃঙ্খলকে মর্যাদা দেয় না এবং এর ফলে বহু বুনো প্রাণ নিহত হয়। বিনষ্ট হয় খাদ্য উৎস, প্রজননস্থল ও বিচরণক্ষেত্র। লাউয়াছড়া গ্যাস জরিপের নামে যা হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা ও প্রমাণ আমাদের তাই জানান দেয় ও সতর্ক করে।
মাগুরছড়াকে অঙ্গার করে ঝলসানো বন ফেলে রেখে অক্সিডেন্টাল লাপাত্তা হয়েছিল। ক্ষতিপূরণ ও ক্ষত সারানোর দাবি আমরা ২৬ বছর ধরে জানিয়েই যাচ্ছি। গ্যাস অনুসন্ধানের মাধ্যমে রাজকান্দি বনের সঙ্গে আবার এমন কোনো নির্দয় কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে কি? রাজকান্দি বন দেশে দ্বিতীয়টি নেই। গ্যাস জরিপের এই নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে বনটিকে কি আমরা মুক্তি দিতে পারতাম?
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় বিস্তৃত রাজকান্দি সংরক্ষিত বনের আয়তন প্রায় ২ হাজার ৪৫০ হেক্টর এবং এই অঞ্চল ‘ইন্দো-বার্মা প্রাণবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ অঞ্চল’-এর অংশ। দেশে যত অরণ্য অঞ্চল আমাকে সবচেয়ে বেশি শিখিয়েছে, রাজকান্দি তার অন্যতম।
১৯৯৮ সালে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় রাজকান্দির সঙ্গে। আদমপুর-কাউয়ারগলা ছাড়িয়ে কালেঞ্জি, কুরমা-কামারছড়া-কাঁঠালকান্দি ছাড়িয়ে তৈলুং। আমার শিক্ষক খাসি কবিরাজ নসিফ পথমি, নেইত খেন্দ্রিয়াম কিংবা বেল পডংদের সঙ্গে রাজকান্দির টিলাবন ছড়া কত দিন-রাত ঘুরে বেড়িয়েছি! জীবনের প্রথম বৃক্ষ ফার্ন, বিশাল কাষ্ঠল লায়ানা, উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, বিচিত্র পতঙ্গ বা বাদুড়, আলো ছড়ানো ছত্রাক এই বনেই দেখেছি। পিছল পাহাড়ি ছড়াপথ, প্রবীণ গাছের খোঁড়ল, বুনো ঝোপ কিংবা হামহামের মতো ঝরনা আর কোথায় গেলে পাব! বনের চার ধারে খাসি, ত্রিপুরা, মণিপুরি কিংবা চা বাগানের এত জাতিবৈচিত্র্য আর কোথায় আছে!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল রাজকান্দি বনের উদ্ভিদবৈচিত্র্যের ওপর গবেষণা করে একটি তালিকা তৈরি করে। ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ জার্নাল অব প্লান্ট ট্যাক্সোনমি’তে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়। তারা রাজকান্দি বনে ১২৩টি উদ্ভিদ পরিবারের প্রায় ৫৪৯ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ শনাক্ত করে। প্রায় ১২ প্রজাতির বটগাছ এবং ১০ প্রজাতির কাষ্ঠল লতার বৈচিত্র্য খুব কম বনেই আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় রাজকান্দি বনে সোনালি বিড়াল, এশীয় কালো ভালুক, বনছাগল, খুদে নখের ভোঁদড়, বনরুইসহ প্রায় ৪০ প্রজাতির স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীর সন্ধান পেয়েছে। প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখির আবাস এই বনে। ১৯৭৩ সালে গৃহীত বিপন্ন বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদ প্রজাতির বাণিজ্য সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ বা সাইট্রাসভুক্ত বহু উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিচরণস্থল এই বন। এমন ঐশ্বর্যময় ও বিরল বন্যপ্রাণে ভরপুর একটি বনের ভেতর গ্যাস জরিপের নামে কোনো ধরনের বিস্ফোরণ, খনন বা রাসায়নিক ব্যবহার কাম্য হতে পারে না।
২০০৮ সালে ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক গ্যাস জরিপের জন্য লাউয়াছড়া বনের ১৫২ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২২ মিটার গভীর গর্ত করে ১ হাজারটি পয়েন্টে প্রায় আড়াই হাজার বিস্ফোরক সেট করে। একটি এলাকায় বিস্ফোরক সেট করার জন্য প্রায় ৩.৩ বর্গমিটার বনতল ধ্বংস করা হয়। গ্যাস জরিপের সামগ্রিক প্রক্রিয়া লাউয়াছড়া বনের ক্ষতি করেছে। এই ক্ষত এখনও সারেনি। আমরা কোনোভাবেই চাই না গ্যাস অনুসন্ধানের নামে আবার কোনো লাউয়াছড়া, মাগুরছড়ার পরিণতি ঘটুক রাজকান্দি বনের জীবনেও। প্রাণ-প্রকৃতির জটিল বিন্যাস ও বিস্তার নিয়ে রাজকান্দি চিরকাল আমাদের কাছে বিস্ময় জাগিয়ে রাখুক। বনের ভেতর বহুজাতিক খনন ও বিপজ্জনক জরিপ বন্ধ করে রাজকান্দির ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক।
পাভেল পার্থ: লেখক ও গবেষক
মন্তব্য করুন