দেশের সড়ক-মহাসড়কে চলমান নৈরাজ্যের আরেক সাক্ষীরূপে রবিবার সকালে মাদারীপুরের শিবচরে সংঘটিত হইল ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা, যাহার কারণে প্রাণ হারাইয়াছেন ২০ জন এবং আহত হইয়াছেন অন্তত ২৫ জন। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা যাইতেছে, খুলনা হইতে ঢাকাগামী ইমাদ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসটি খুলনা-ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ের মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারাইয়া খাদে পড়িয়া দুমড়াইয়া-মুচড়াইয়া এই মর্মন্তুদ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রস্তুতকৃত বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বৎসর দেশে সাড়ে ছয় সহস্রাধিক সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ সহস্র ৯৫১ জনের মৃত্যু হইয়াছে, যাহা প্রতিদিনের হিসাবে ২৭ জনের অধিক। এই সকল দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে দেশের সাধারণ সড়ক ও মহাসড়কে, যেথায় গতির সহিত নিয়ম না মানিবার প্রতিযোগিতা চলে বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। কিন্তু যান চলাচলে বিশৃঙ্খলার সুযোগ কম থাকিবার পরও নবনির্মিত এক্সপ্রেসওয়েতে যখন প্রধানত বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের কারণে এত বড় ট্র্যাজেডি ঘটে তখন বোঝা যায়, সড়ক পরিবহন খাতে গোড়াতেই যেহেতু গলদ রহিয়াছে সেহেতু অন্তত সড়ক নিরাপত্তার প্রশ্নে সাধারণ সড়ক আর এক্সপ্রেসওয়ের মধ্যে পার্থক্য চলে না।

বস্তুত ইহা এখন ‘ওপেন সিক্রেট’ যে, দেশের সড়ক পরিবহন খাত চলে মূলত পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতাদের খেয়ালখুশিতে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ নামে একটা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে বটে, কিন্তু বহু আলোচনা-সমালোচনা সত্ত্বেও সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় উহার দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নাই। ফলস্বরূপ সড়ক-মহাসড়কে একদিকে ‘উপযুক্ততাহীন’ যানের বাহুল্য দেখা যায়, আরেকদিকে ঐ সকল যানের চালক অনেকেরই নাই প্রকৃত ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কিংবা ট্রাফিক বিধি সম্পর্কিত জ্ঞান।

চালক ও শ্রমিকদের মানসম্মত মজুরি দূর স্থান; নিয়োগপত্রও নাই। বিদ্যমান সড়ক পরিবহন আইনে দৈনিক শ্রমঘণ্টা নির্দিষ্ট করা থাকিলেও উহার প্রতিপালন হয় না বলিলেই চলে।
উপরে যতগুলি সমস্যার কথা বলা হইল, তন্মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রযোজ্য আলোচ্য বাসটির ক্ষেত্রে। প্রতিবেদন অনুসারে, গত ১৯ জানুয়ারি বাসটির ফিটনেস সনদের মেয়াদ শেষ হয়। তদুপরি গত নভেম্বরে গোপালগঞ্জের গোপীনাথপুরে দাঁড়াইয়া থাকা ট্রাককে ধাক্কা দিয়া পুলিশসহ তিনজন হত্যা করিবার পর উহার চলাচলের অনুমতি স্থগিত করা হয়। তৎসত্ত্বেও ঢাকা-খুলনা এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করিতে বাসটির কোনো অসুবিধা হয় নাই। সমকালের প্রতিবেদনে এমনটাও বলা হইয়াছে, ঢাকা হইতে খুলনা যাওয়ার পর বাসটির চালক প্রায় কোনো বিশ্রাম ব্যতিরেকেই ফিরতি ট্রিপ পরিচালনা করিতেছিল। বলা বাহুল্য নহে, এত অনিয়মের পর দুর্ঘটনাটি না ঘটিলেই বরং তাহা অস্বাভাবিক মনে হইত।

দুর্ভাগ্যজনক, সড়ক খাতের এহেন নৈরাজ্য সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ অবগত থাকিবার পরও উহা পরিবর্তনে অদ্যাবধি কার্যকর কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হইতেছে না। খোদ সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বহুবার বিআরটিএতে গাড়িয়া বসা দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা, তৎসহিত চালক-শ্রমিকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকার কথা স্বীকার করিয়াছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও দুর্ঘটনার সহিত পরিবহন শ্রমিকদের দায়িত্ব পালনকালে পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পাওয়ার নিবিড় সম্পর্কের কথা মালিক ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে বারবার স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে শুধু নিহত বা আহত মানুষদের স্বজনেরাই ক্ষতির মুখোমুখি হন না; দেশও প্রতি বৎসর জিডিপির দেড়-দুই শতাংশ হইতে বঞ্চিত হয়।

আমরা মনে করি, সড়কে নৈরাজ্য যে রূপ ধারণ করিয়াছে, উহা পরিবর্তনে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত কোনো পদক্ষেপে কাজ হইবে না। সময় আসিয়াছে সম্পূর্ণ পরিবহন খাতকেই ঢালিয়া সাজাইবার। উহার প্রধান লক্ষ্য হইবে বিআরটিএর অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা বন্ধ, তৎসহিত সড়ক পরিবহন আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া আমরা মনে করি।