জানা গেছে, সারাদেশে গত সাত বছরে সরকারীকরণের প্রক্রিয়াধীন (২০১৬-২৩) মোট ৩২৬টি কলেজের মধ্যে অন্তত ২০০টিতেই অধ্যক্ষের পদটি শূন্য রয়েছে। অধ্যক্ষ না থাকায় কোথাও উপাধ্যক্ষ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ একজনকে দায়িত্ব দিয়ে কোনো রকমে অধ্যক্ষের কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ২০১৬ সালে নতুন কলেজগুলো সরকারীকরণের ঘোষণা হয়। জিও (সরকারি আদেশ) জারি হয় ২০১৮ সালে। এর সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হয়ে যায় গভর্নিং বডি। স্থগিত করা হয় সব ধরনের নিয়োগ (অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, শিক্ষক, কর্মচারী)। কলেজগুলোতে নিয়মিত অধ্যক্ষ এমনকি উপাধ্যক্ষও নেই। গভর্নিং বডি বাতিল, শিক্ষকের পদ শূন্য– এভাবেই চলছে বছরের পর বছর!

শিক্ষকের স্বল্পতা, বিশেষ করে দীর্ঘদিন অধ্যক্ষশূন্য থাকা এসব প্রতিষ্ঠানে দুরারোগ্য ব্যাধির রূপ ধারণ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’ প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে একদিকে গলদঘর্ম, অন্যদিকে তাঁদের কর্মকাণ্ডে সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই কার্যকর গতি। আমার নিজ জেলা কিশোরগঞ্জে সরকারি হওয়া ১১টি কলেজের মধ্যে আটটিই অধ্যক্ষশূন্য। শুধু অধ্যক্ষ নয়; ডিগ্রি স্তরের এই আটটি কলেজের মধ্যে দু-একটি ছাড়া কিশোরগঞ্জের বাকিগুলোতে উপাধ্যক্ষও নেই। নিয়মিত অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ না থাকায় শিক্ষকদের মধ্য থেকে ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুধু কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল নয়; সরকারি হওয়া কলেজগুলোর এমন চিত্র সারাদেশেই।

প্রধানমন্ত্রীর একান্ত আগ্রহে ২০১৬ সালে ঘোষণার পর একের পর এক বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে এখন চলছে শিক্ষক-কর্মচারীদের পদায়নের কাজ। সরকারীকরণের প্রক্রিয়াধীন উল্লিখিত ৩২৬টি কলেজের মধ্যে লক্ষ্য করার বিষয়. অন্তত ২০০টি কলেজেই (দুই-তৃতীয়াংশ) অধ্যক্ষের পদ শূন্য। আনুমানিক ১০০টি কলেজ রয়েছে একই সঙ্গে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষহীন। দুই বছর, চার বছর এমনকি টানা আট-দশ বছর ধরে কলেজগুলো চলছে ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’ দিয়ে। ‘ভারপ্রাপ্ত’ একটি সাময়িক ব্যবস্থা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কখনও তা হতেই পারে। তাই বলে বছরের পর বছর, পাঁচ বা সাত বছর কিংবা আরও বেশি সময় ধরে এই সাময়িক ব্যবস্থা? কলেজের মতো একেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেগুলোতে দুই হাজার, তিন-চার-পাঁচ হাজার বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী; ৪০, ৬০ কিংবা এর চেয়েও বেশি সংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী!

এ ছাড়া ‘ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ’রূপে  নিয়োগ নিয়ে চলছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এক ধরনের তেলেসমাতি কাণ্ড। আইন ও প্রচলিত বিধিবিধান লঙ্ঘনের ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। মতলববাজ এক শ্রেণির শিক্ষক ও রাজনীতিক এবং মাউশি ও মন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত একটি চক্র কী এক অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে তা জিইয়ে রেখেছে, তা সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারও পক্ষে বোধ করি কল্পনা করাও কঠিন। এ নিয়ে স্থানে স্থানে মামলা-মোকদ্দমা, দেনদরবার, জালজালিয়াতি, লুকোচুরি, শিক্ষকদের মধ্যে মারামারি– আরও কতকিছু ঘটমান! দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়েছে ডজন ডজন কলেজের নাম।

আরও একটি কথা। ভারপ্রাপ্ত হিসেবে অধ্যক্ষের চেয়ারটিতে একবার একজনকে ‘বসানো’, কিছুদিন পর সেখান থেকে তাঁকে ‘নামানো’ এবং নামিয়ে নতুন করে অন্য কাউকে বসানো আবার নামানো; এভাবে চলে ‘বসানো-নামানো’র অদ্ভুত ও অভিনব খেলা। এই অ-মহৎ কাজে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের খবরও বাতাসে ওড়ে। কখনও জ্যেষ্ঠ, কখনও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে অপেক্ষাকৃত কনিষ্ঠ শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়ায় বিভিন্ন কলেজে কী এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি! যেন দেখার কেউ। গত আট বছরে কয়েক হাজার শিক্ষক ও কর্মচারী অবসরপ্রাপ্ত। অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন।

সরকারীকরণের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার পাশাপাশি উল্লিখিত কলেজগুলোতে স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হোক। দীর্ঘদিন অধ্যক্ষশূন্যতার কারণে একাডেমিক কার্যক্রমে ছন্দপতন ঘটে। অধ্যক্ষ হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক থাকার পরও কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে দিনের পর দিন কলেজগুলো ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালানোর যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। একদিকে ভারপ্রাপ্ত দিয়ে কলেজ চালানো হচ্ছে, অন্যদিকে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক অধ্যক্ষ হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে অবসরে চলে যাচ্ছেন। এটি শিক্ষা-সংশ্লিষ্টদের কাছে অপ্রত্যাশিত।

বিমল সরকার: অবসরপ্রাপ্ত ,কলেজ শিক্ষক