ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

জোট সম্প্রসারণের ১৪ দলীয় সংকট

রাজনীতি

জোট সম্প্রসারণের ১৪ দলীয় সংকট

সাইফুর রহমান তপন

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৩ | ১৮:০০

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরপর ১৪ দলীয় জোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্য শরিকদের যে টানাপোড়েন শুরু হয়; এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে জোট নেতাদের বৈঠকের মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটেছে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় মনে হচ্ছে, ওই সংকট আসলে কাটেনি। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জোটসঙ্গীদের আশ্বস্ত করেন– দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন তাঁরা একসঙ্গেই করবেন। কিন্তু গত ১৩ মার্চ ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমুর বাসায় ১৪ দলের বৈঠকে শরিকদের পক্ষ থেকে আবারও অভিযোগ করা হয়– আওয়ামী লীগ ‘একলা চলো’ নীতিতেই অটল।

এ প্রসঙ্গে একটি ইংরেজি দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে বলা হয়েছে– সভায় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন প্রশ্ন তুলেছেন, “আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছে এবং ‘নৌকা’ প্রতীকের জন্য ভোট চাইছে। তাহলে আমরা কোথায়? আমাদেরও কি নিজেদের মতো করে প্রচারণা শুরু করা উচিত? আমাদের নির্বাচনী প্রতীকে ভোট চাওয়া শুরু করা উচিত?” একই সভায় বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়াও আগামী জাতীয় নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণার সমালোচনা করেন। তাঁর প্রশ্ন ছিল, ‘মোশাররফ হোসেনের ছেলে কেন প্রার্থী হবেন? আমাকে কেন মনোনয়ন দেওয়া হবে না?’ বৈঠকে যদিও আমু এটা স্পষ্ট করেন– আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট নিয়েই পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এবং শরিকদের নিয়ে বৈঠক করেই আসন ভাগাভাগি করা হবে; তাতে শরিকরা কতটুকু আস্বস্ত হয়েছেন– সন্দেহ।
স্মরণ করা যেতে পারে, বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয় সংসদীয় আসনে গত ১ ফেব্রুয়ারি যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ওয়ার্কার্স পার্টিকে আওয়ামী লীগ ঠাকুরগাঁও-৩ আসনটি ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু রাশেদ খান মেননের অভিযোগ অনুসারে শাসক দলের অসহযোগিতার কারণে দলটি সেখানে পরাজিত হয়। ফলে জোট চর্চায় আওয়ামী লীগের আন্তরিকতা নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির অভিযোগ নিছক কথার কথা নয়।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর ১৪ দলে সৃষ্ট টানাপোড়েনের কারণটাও এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার। একসঙ্গে নির্বাচন করলেও নির্বাচনের পর খোদ প্রধানমন্ত্রী ১৪ দল শরিকদের ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানো’র পরামর্শ দিয়ে শুধু নিজ দলের লোকদের নিয়ে সরকার গঠন করেন। এমনকি তখন আওয়ামী লীগ যে বিজয় সমাবেশ করে, তাতেও জোট শরিকদের কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই এতে শরিক দলগুলোর নেতারা প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এমনকি তাঁরা ২০০৪ সালে ১৪ দল গঠনকালে ‘একসঙ্গে আন্দালন, একসঙ্গে নির্বাচন ও একসঙ্গে সরকার গঠন’-এর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গেরও অভিযোগ আনেন শাসক দলের বিরুদ্ধে।

আসলে ওই নির্বাচনে প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রচণ্ড ভগ্নদশা দেখে আওয়ামী লীগ প্রবল আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। অন্তত ওই মুহূর্তে সংসদের ভেতরে তো বটেই, সংসদের বাইরেও উল্লেখযোগ্য কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার শঙ্কা না থাকায় তারা নিজের জোটসঙ্গীদেরই বিরোধী দলের আসনে ঠেলে দেওয়ার কৌশল নেয়। কিন্তু তাতে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং মাটিঘেঁষা দলটির অন্তত দূরদৃষ্টির প্রতিফলন ছিল না। এটা আজ স্পষ্ট– যখনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে এবং এ নিয়ে বিরোধী শিবির নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠ গরম করার চেষ্টা চালায়, তখনই শাসক দল পুরোনো মিত্রদের কাছে টানতে শুরু করে। ১৪ দলকে পুনর্জীবন দেওয়ার চেষ্টা তারই অংশ বললে অত্যুক্তি হবে না।

এখনও কি আওয়ামী লীগ ১৪ দলকে আগের আন্তরিকতা নিয়ে সংগঠিত করতে চায়? অন্তত দৃশ্যমান ঘটনাবলি এ প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দেয় না। বিএনপি আগামী নির্বাচন, বিশেষত শাসক দলের ছক অনুসারে করবেই– এখনও তা স্পষ্ট নয়। ফলে আওয়ামী লীগকে একাধিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। যার একটা হলো বিএনপির অনুপস্থিতিতে নিজের জোটসঙ্গীদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে উদ্বুদ্ধ করা। এ সম্ভাবনা যতদিন থাকবে ততদিন ১৪ দলের শরিকদের মন জুগিয়ে চলা আওয়ামী লীগের জন্য জরুরি নয়।

ঠিক একই কারণে আওয়ামী লীগ কতিপয় ইসলামপন্থি দলকে অন্তর্ভুক্ত করে ১৪ দলকে সম্প্রসারিত করার জন্য শরিকদের চাপ দিচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, বিএনপির সঙ্গে ইসলামপন্থি দলগুলোর যে ঐতিহাসিক সখ্য, তাতে চিড় ধরাতে হলেও আওয়ামী লীগকে ওই দলগুলোকে সঙ্গে নিতে হবে। এ কারণেই ১৪ দলে এ মুহূর্তে না নিলেও আওয়ামী লীগ তাদের দূরেও ঠেলেও দিচ্ছে না। ১৩ মার্চের বৈঠক শেষে আমুও বলেছেন, ইসলামপন্থি যে দলগুলো ইতোমধ্যে ১৪ দলীয় জোটে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে, তারা একটি পৃথক জোট গঠন করে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কারও কারও ধারণা, পরিস্থিতি যদি এমন হতো যে, জোটে না নিলে ওই দলগুলো বিএনপির সঙ্গে ভিড়ে যাবে, তাহলে যে কোনোভাবে হোক আওয়ামী লীগ ১৪ দলভুক্ত হওয়ার ইসলামপন্থি দলগুলোর আগ্রহ পূরণ করত।

বলা হতে পারে, জাসদ তো প্রকাশ্যে কোনো অসন্তোষ প্রকাশ করছে না। এটা ঠিক, ১ ফেব্রুয়ারি যে উপনির্বাচনে জাসদের প্রার্থী আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় বগুড়া-৪ আসন থেকে জয়ী হন; উপরন্তু বিএনপিরই ছেড়ে দেওয়া সংরক্ষিত নারী আসনটিও শাসক দলের বদান্যতায় জাসদ লাভ করে। ফলে জাসদ নেতাদের গলায় বোধগম্য কারণেই ১৪ দল নিয়ে আপাতত কোনো অসন্তোষ শোনা যাচ্ছে না। তবে এ অবস্থা কতদিন থাকবে, তা জোর দিয়ে বলা কঠিন। ইসলামপন্থি দলগুলোকে ১৪ দলভুক্ত করার ব্যাপারে জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু ইতোমধ্যে বলেছেন, ১৪ দলের বাইরেও এদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা আওয়ামী লীগের উচিত হবে না।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল


আরও পড়ুন

×