
আজ পকিস্তানের জাতীয় দিবস। দেশটির জাতির পিতা ‘কায়েদে আযম’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পৈতৃকসূত্রে ছিলেন খোজা ইসমাইলি সম্প্রদায়ভুক্ত। পরবর্তী সময়ে তিনি প্রথমে শিয়া, পরে সুন্নি মতবাদ গ্রহণ করেন, যদিও কার্যত ‘প্র্যাকটিসিং মুসলিম’ ছিলেন না। তাঁর এমন ‘সুবিধাবাদ’ সম্পর্কে আরও অনেক গল্প প্রচলিত।
যা হোক, বিলেত শিক্ষিত ব্যারিস্টার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছিলেন কেতাদুরস্ত ও আইন পেশায় চৌকস। ধর্মের প্রতি তেমন আগ্রহ না থাকলেও সেই তিনিই একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত জিন্নাহ ও পাকিস্তান শব্দদ্বয় সমার্থক হয়ে ওঠে। যদিও তিনি প্রথম জীবনে যুক্ত ছিলেন ভারতের কংগ্রেস দলের সঙ্গে। কোনো কোনো ঐতিহাসিক এমন তথ্যও দেন, প্রথমদিকে জিন্নাহর চিন্তাধারা বামঘেঁষাও ছিল।
১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নবাব স্যার সলিমুল্লাহ যখন মুসলিম লীগের জন্ম দেন; ব্যারিস্টার জিন্নাহ তখনও ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির কথা ভাবেন। ১৯২০ সালে ব্যারিস্টারি পড়তে যান ইংল্যান্ডে। তিন বছর পর ফিরে এসে ১৯২৪ সালে যোগ দেন মুসলিম লীগে। ক্রমেই হয়ে যান মুসলিম লীগের প্রধান নেতা।
২২ মার্চ ১৯৪০-এ লাহোরে বসেছিল নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলন। ২৩ মার্চ উত্থাপন করা হয় ভারতবর্ষের মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো নিয়ে আলাদা রাষ্ট্রের ধারণা সংবলিত একটি প্রস্তাব। প্রস্তাবটি উথাপন করেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। তাতে বলা হয়, ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অংশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। ওই প্রস্তাবের কোথাও একক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা ছিল না। তবে পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই ২৩ মার্চই হয়ে যায় দেশটির জাতীয় দিবস।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ধর্মের ভিত্তিতে জাতি নির্ণয় করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে তিনি দুনিয়াতে যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছিলেন, তা টেকেনি। তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির পর এক বছরের কিছু সময় বেশি বেঁচে ছিলেন। ব্রিটিশ আদলে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পদ অলঙ্কৃত করে ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর করাচিতে মৃত্যুবরণ করেন। ততদিনে পূর্ববাংলার বাঙালি জনগোষ্ঠী তাদের ভাষার স্বীকৃতির জন্য লড়াই শুরু করে দিয়েছে। ভাষা সংগ্রামের পথ ধরেই ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়ে যায় পূর্ববাংলা, আজকের বাংলাদেশ।
পাকিস্তানে প্রথম সেনা অভ্যুথান ঘটে ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে। পাকিস্তানের প্রথম সেনাপ্রধান আকবর খান পাঠান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহির কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের সমর্থনে পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সে বছরই দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান, যার বিচার আজও হয়নি। একটা সংবিধান প্রণয়ন করা হয় দেশটির জন্মের আট বছরের মাথায় ১৯৫৬ সালে। দুই বছর পর ১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে সেই সংবিধান বাতিল করে দেয়।
বর্তমানে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর কথাই শেষ কথা। এটি এমন এক রাষ্ট্র, যেখানে সেনাপ্রধান পারভেজ মোশাররফ বরখাস্ত করে দেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে। আর এই বরখাস্তের অনুমোদন সঠিক– এমন রায় দেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। পাকিস্তান সেনাবাহিনীই পৃথিবীর একমাত্র সেনাবাহিনী, যারা নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পাকিস্তানে বিগত ৭৫ বছরের ইতিহাস হত্যা, ষড়যন্ত্র, বোমা হামলা, মৃত্যু, ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর দুর্নীতির ইতিহাস। সাম্প্রতিককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন– পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রই না। অথচ পাকিস্তানের সারাজীবনের বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ ৭৫ বছরের পাকিস্তানকে পেরিয়ে এগিয়ে গেছে বহুদূর। বাংলাদেশের ১০০ টাকায় এখন আড়াইশ পাকিস্তানি রুপি।
আর পাকিস্তানের রাজনীতিকরা আজও শুনিয়ে যাচ্ছেন ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের মাহাত্ম্য। শূন্য থালা হাতে আজও সেই কাহিনি শুনে যাচ্ছে পাকিস্তানের ২৩ কোটি নিরীহ জনগণ। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ব্যক্তিগত খামখেয়ালি ও আকাঙ্ক্ষার খেসারত তারা কতদিন দেবে, জানা নেই।
রুস্তম আলী খোকন : সাবেক ছাত্রনেতা ও সংগঠক
মন্তব্য করুন