আমাদের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তার কথা বলা আছে। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গীকারে ঘাটতির কারণে সেই সুফল নাগরিকরা অনেক সময় পাচ্ছেন না। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ভারত থেকে অবৈধ পথে এনে মজুত করা হতো হেপাটাইটিস-বির আমদানি-নিষিদ্ধ টিকা। পরে একটি ভেঙে ১০টি নকল অ্যাম্পুলে ভরে চলত জরায়ুমুখ ক্যান্সারের টিকা হিসেবে সরবরাহের প্রক্রিয়া। সেগুলোর একেকটি বিক্রি হতো আড়াই হাজার টাকায়। ফলে ৩৫০ টাকায় কেনা একটি নিষিদ্ধ টিকা ভিন্ন নামে বিক্রি করে মেলে ২৫ হাজার টাকা। এ প্রতারণার সঙ্গে জড়িত চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে ভয়ংকর এসব তথ্য।

এসব নকল টিকা অবশ্যই মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যাঁরা এরই মধ্যে প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে নকল টিকা নিয়েছেন, তাঁদের সুরক্ষায় সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। নকল টিকা নেওয়া নারীরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করে সেবা নিতে পারেন। জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরাও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হলেও সঠিক চিকিৎসা নিয়ে নিজেদের ঝুঁকিমুক্ত রাখতে হবে।

নকল ওষুধ ও টিকা উৎপাদন এবং বাজারজাতকারীদের শনাক্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার মূল কর্তৃপক্ষ হচ্ছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে আইন রয়েছে। এটি বাস্তবায়নে কাজ করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। তাদের সহযোগিতা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মাঝেমধ্যে বাজার থেকে ওষুধ নিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা দরকার তা ঠিক আছে কিনা। তবে এ ক্ষেত্রে জনবল সংকট রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও এ বিষয়ে তদারকির জন্য বিশেষজ্ঞ নেই। এদিক বিবেচনা করলে বলা যায়, নকল টিকা ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি মহাকাব্যিক অবহেলার শিকার। অথচ নকল ওষুধ ও টিকার সঙ্গে মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত। কাজেই এ খাতকে অবহেলা করলে এর পরণিতি ভয়াবহ। তাই প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার।

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে যেমন শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ দরকার; একইভাবে নিরাপদ ওষুধ নিশ্চিতেও শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ জরুরি। এ দুটি খাতে গুরুত্ব না দিলে একদিকে ভেজাল খাওয়া রোগী বাড়াবে; অন্যদিকে নকল ওষুধ বা টিকা রোগীর রোগ নিরাময় না করে উল্টো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে দক্ষ জনবল নিশ্চিত করা গেলে তারা নিয়মিত তদারক করতে পারবে। ওষুধের কারখানা থেকে শুরু করে দোকানে নিয়মিত তদারকি চালাতে হবে। হঠাৎ অভিযান পরিচালনা করে নকলকারীদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়াতে হবে।

সংবাদমাধ্যমে এসব জালিয়াতির খবর প্রকাশিত হলে আমরা তৎপর হই। দুর্ঘটনার পর সাময়িক তৎপরতা চালিয়ে দীর্ঘমেয়াদে সুফল আশা করা যায় না। নিয়মিত তদারকি চালাতে হবে। সংবাদমাধ্যমে এসব চক্রের একটি অংশের কথা এসেছে। এ রকম আরও যারা দিনের পর দিন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে; মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করছে, তাদের শনাক্ত করা জরুরি। অনুসন্ধান ও তদন্তের মাধ্যমে এটি বের করে আনা যেতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তৎপর হলে এসব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা কঠিন বিষয় নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে সম্পৃক্ত আইন করা হয়েছে। কিন্তু এর যদি সঠিক প্রয়োগ না হয়, তাহলে কাগুজে আইন দিয়ে লাভ হবে না। কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কিনা, তা তদারকির কথা আইনে বলা আছে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না। তবে কোন কোন ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে, তাও নির্দিষ্ট আছে। অনেক সময় ডাক্তার টেলিফোনে ওষুধ দেন। সে ক্ষেত্রে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি না করলে সমস্যা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা ভাবা যেতে পারে। সাধারণ মানুষ তথা রোগীর স্বার্থ ও নিরাপত্তা সবার আগে। আইনে ত্রুটি দেখছি না, কিন্তু প্রয়োগের অভাবে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ৫ লাখ ৭০ হাজার নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মৃত্যু হয় অন্তত ৩ লাখ ১০ হাজার নারীর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১৮ হাজার নারী নতুন করে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর প্রতি বছর ১২ হাজার নারী মারা যাচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় জরায়ু ক্যান্সারকে অবহেলা করার সুযোগ নেই।

ক্যান্সার আক্রান্ত নারীর বেশিরভাগই জরায়ু ও স্তন ক্যান্সারে ভুগছেন। এ অবস্থায় ঘাতক ব্যাধিখ্যাত ক্যান্সারের টিকার কথা শুনলে তাঁরা আগ্রহ দেখাবেন– এটি স্বাভাবিক। কিন্তু সেই টিকা কতটুকু মানসম্মত; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা আমাদের দেশের সরকার তা অনুমোদন করেছে কিনা; এসব যাচাই না করে টিকা নেওয়া উচিত নয়। পোলিও থেকে শুরু করে করোনার টিকা– সব ধরনের টিকা দেওয়ার আগে সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, টেলিভিশনে প্রচারণা চালানো হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংবাদমাধ্যমে কথা বলেন। এর পর স্থানীয়ভাবে মাইকিং করা হয়। সরকার অনুমোদিত নির্দিষ্ট টিকাকেন্দ্রে টিকাগ্রহীতাদের যেতে আহ্বান জানানো হয়। জরায়ুর টিকা দেওয়া হলে সেটিই করা হতো। কিন্তু একটি চক্র স্থানীয়ভাবে মাইকিং করল আর তাতেই টিকা নিতে ছুটে যাওয়া সমীচীন নয়।

যারা জালিয়াতি করে নকল টিকা বাজারজাত করেছে, তারা একেবারে আনাড়ি হতে পারে না। কারণ এ বিষয়ে জ্ঞান নেই– এমন লোকের পক্ষে এত বড় প্রতারণা করা সম্ভব নয়। তাই অপরাধীদের পেছনে আর কারা রয়েছে, তা তদন্ত করে বের করা দরকার। অর্থের লোভে যারা নৈতিকতা ও মানবতাবোধ বিসর্জন দিতে পারে, তাদের আইনের আওতায় এনে অন্যদের বার্তা দিতে হবে। ধরা-অধরা সব অপরাধীকে বোঝাতে হবে– মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করার পরিণতি কতটা ভয়াবহ। জনগণকেও সচেতন হতে হবে। সরল বিশ্বাসে প্রতারিত হওয়া যাবে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সচেতন করলে আর কোনো রোগী প্রতারিত হবেন না।

ডা. মুশতাক হোসেন: রোগতত্ত্ববিদ; সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)