যমুনা নদীকে ছোট করার বিষয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) একটি প্রকল্প ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিয়েছে। গত ১১ মার্চ একটি বাংলা দৈনিকে এ সংক্রান্ত একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী ড. শ্যামল চন্দ্র দাস বলেছেন, ‘এত বড় নদীর প্রয়োজন নেই। তা ছোট করতে পাইলট প্রকল্প হিসেবে নেওয়া হয়েছে।’ এটি জেনে একটা বড় ধাক্কা খেলাম এবং বুঝতে চেষ্টা করলাম, এ নিয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে কিনা। জানলাম, এটা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি এবং এমন প্রকল্পের কোনো নজিরও নেই।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের বক্তব্য হচ্ছে, যমুনা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী নদী। এর প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। এই নদী অত্যন্ত ভয়ংকর। এটাকে বোঝা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এই নদীতে স্টেপ বাই স্টেপ কাজ করতে হবে। যা খুশি তা করা যাবে না। কথা নেই, বার্তা নেই; সাড়ে ছয় কিলোমিটার প্রশস্ততা কমানো হবে– যমুনা নদী এটা মানবে না। যমুনার কাছে ১ হাজার ১০৯ কোটি টাকা কিছুই না; উড়ে চলে যাবে। অনুমোদন পেলেও এটা করা সহজ হবে না।

বিশিষ্ট নদী গবেষক ও সাংবাদিক শেখ রোকন মনে করেন, প্রবাহের দিক থেকেও যমুনা দেশের সবচেয়ে বড় নদী। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৪টি। এর মধ্যে গঙ্গা, তিস্তা, বরাকসহ বাকি ৫৩টি যে পরিমাণ পানি বহন করে; ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা একাই তার চেয়ে বেশি পানি বহন করে। বাংলাদেশ অংশে ২৩০ কিলোমিটার যমুনা বা ব্রহ্মপুত্র সংকুচিত করা হলো; ভারতের অংশ অবারিতই থাকল। ফলে নদীপ্রবাহ যদি অন্য দিক দিয়ে যেতে চায়, তাহলে তো মহাবিপর্যয় ঘটে যাবে।
পাউবো ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় আসলে যমুনা নদীকে নিয়ে কী করতে চায়? প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কথিত এই পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে ‘যমুনা নদীর প্রশস্ততা ১৫ কিলোমিটার থেকে সাড়ে ৬ কিলোমিটার কমানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এবং জানা গেছে, ‘যমুনা নদীর তীর রক্ষা এবং ঝুঁকি প্রশমনে টেকসই অবকাঠামো’ নামে প্রস্তাবিত প্রকল্পটি ইতোমধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।

একটি প্রকল্প নিশ্চয় রাতারাতি এবং কোনো একক ব্যক্তির খেয়ালের বশে তৈরি হয় না। তার জন্য দাপ্তরিক কিছু  প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় এবং সংশ্লিষ্টদের অনুমোদন-সমর্থনের ভিত্তিতেই তা হয়। তার মানে, কাজটি সংঘবদ্ধ প্রক্রিয়ার অংশ এবং তা অনেক দূর এগিয়েছে। দেশ এখন এক চরম অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। বাংলদেশের বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ জন্য বৈদেশিক বাণিজ্য ও কাজকর্মও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ সংকটের কারণে সরকার শর্তসাপেক্ষে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীও দেশ ও বিশ্বের চলমান সংকটের কারণে তাঁর একাধিক ভাষণে কৃচ্ছ্র সাধনের কথা বলেছেন। অপচয় বন্ধ করতে বলেছেন। এমনকি অর্থ সংকটের কারণে সরকারের কিছু পরিকল্পনা খণ্ডিত ও ধীর করা হয়েছে। আমলাদের বিদেশ সফরে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সেখানে কোনো প্রকার জরিপ-গবেষণা ছাড়া এমন একটি উচ্চ ব্যয়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয় কী করে?

বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্প মানে কিছু মানুষের দুর্নীতি, লুটপাট ও কমিশনের সুযোগ তৈরি হয়। এর মধ্যে আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরা থাকেন। পত্রিকায় এ সম্পর্কিত অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আলোচ্য প্রকল্পে এমন কিছু নেই– তা হলফ করে বলা যায় না।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি প্রধান স্লোগান ও রণধ্বনি– ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ সুতরাং যমুনা শুধু একটি নদী নয়; একটি সংগ্রাম ও চেতনার নামও। আর তাকে কাটাছেঁড়া করা হবে– আমরা দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখব, তা হয় কী করে! যমুনা অববাহিকায় সিরাজগঞ্জ শহর ও জেলা। আমরা দেখেছি যমুনার ভয়ংকর রূপ; আবার শান্ত, স্নিগ্ধ, কোমল। যমুনার পলি-পানিতেই ভরে ওঠে কৃষকের গোলা; জাল ভরে ওঠে রুপালি মাছ।

নদী গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মত– পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই প্রস্তাবনা বিজ্ঞানসম্মত নয়; অবাস্তব, অযৌক্তিক। তাদের মতে, এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে যমুনার মৎস্যসম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে; যমুনা সেতু ও রেললাইনের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে; ভূগর্ভস্থ পানির আধার নষ্ট হয়ে যেতে পারে, নদী সংকোচনের ফলে অনেক এলাকায় পানিপ্রবাহ থাকবে না; ক্ষতিকর এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণের কারণে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ আরও বেড়ে যাবে; যমুনা অববাহিকা ও অঞ্চলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে; নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি, কৃষি ও জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং নদী সংকোচনের নামে নদী অঞ্চল দখলের বাণিজ্য চলবে।

সরকার ও প্রশাসনে সিরাজগঞ্জ ও যমুনা অববাহিকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আছেন। যমুনা অববাহিকায় তাঁদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তেমনি একজন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত– কবির বিন আনোয়ার। তিনি থাকতে এই ধরনের উদ্ভট প্রকল্প প্রণয়নে তারা সময় ও অর্থ নষ্ট করার সুযোগ পান কী করে– সেটা আমার মাথায় আসে না। যমুনা বাংলাদেশের একটি প্রধান নদী। সুতরাং এটা কোনো আঞ্চলিক ইস্যু নয়, জাতীয় বিষয়। সিরাজগঞ্জসহ দেশের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশপ্রেমী সব সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনকে যমুনা নদীকে ছোট করার এই তুঘলকি পরিকল্পনার প্রতিবাদ করতে হবে। সরকারকে এই সর্বনাশা পরিকল্পনা বাতিলে বাধ্য করতে হবে।

ড. মঞ্জুরে খোদা (টরিক): লেখক, উন্নয়ন গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক