- মতামত
- স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার স্বপ্ন

স্বাধীনতার স্বপ্ন মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আমরা সমকালের পাঠক, লেখক, সাংবাদিক, কর্মচারী, বিজ্ঞাপনদাতা, হকার, শুভানুধ্যায়ীসহ বাংলাদেশের মুক্তি ও সমৃদ্ধিকামী সকল নাগরিককে অভিবাদন জানাইতেছি। প্রায় আড়াই দশকের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই ভূখণ্ডে স্বাধীনতার যেই আকাঙ্ক্ষা তীব্র হইয়া উঠিয়াছিল, এই দিবসে উহা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে সংঘটিত ভয়াবহ গণহত্যার অব্যবহিত পরে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঐ ঘোষণার ভিত্তিতে সমগ্র জাতি আক্ষরিক অর্থেই যাহার যাহা কিছু ছিল তাহা লইয়া পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়ে। ৯ মাসের মরণপণ যুদ্ধ শেষে ঐ বৎসরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় আসে, বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে নূতন এক জাতিরাষ্ট্র হিসাবে মস্তক উন্নত করিয়া দাঁড়ায়।
বিশ্বে অতি অল্পসংখ্যক জাতি আমাদিগের ন্যায় সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছে; আবার স্বাধীনতার বেদিমূলে এত অল্প সময়ে এত রক্ত ঝরানোর উদাহরণও বিশ্বে বিরল। এই দিবসে তাই সমগ্র জাতির ন্যায় আমরাও গভীর শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করিতেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁহার সুযোগ্য সহকর্মীবৃন্দ এবং জানা-অজানা অসংখ্য শহীদকে, যাহাদের অতুলনীয় নেতৃত্বগুণ এবং অপরিসীম ত্যাগের কারণে আমরা আজিকে স্বাধীন জাতি হিসেবে গর্ব করিতে পারিতেছি। তবে ইহার পাশাপাশি যে স্বপ্ন লইয়া ৫২ বৎসর পূর্বে এই জাতি বিশ্বের অন্যতম দুর্ধর্ষ এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হাতিয়ার তুলিয়া লইয়াছিল সেই স্বপ্নের কতটুকু পূরণ হইয়াছে উহারও হিসাব-নিকাশ প্রয়োজন বলিয়া আমরা মনে করি; কারণ গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতার বাহিরে জাতীয় অগ্রগতি-অধোগতির হিসাব-নিকাশই দিবসটির মর্ম উপলব্ধির মোক্ষম উপায়।
স্বীকার করিতে দ্বিধা নাই, বিগত পাঁচ দশকেরও অধিক যাত্রায় বাংলাদেশ বহু ক্ষেত্রেই সাফল্য পাইয়াছে; দারিদ্র্যের হার যেমন দারুণভাবে হ্রাস পাইয়াছে, অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের ন্যায় মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি বেশ প্রশংসনীয়; শিক্ষা ও স্বাস্থ্যেও বিশেষত খাতসমূহের বিস্তারের প্রশ্নে সাফল্য কম নহে। এই সময়ে শুধু জিডিপি তথা মোট দেশজ উৎপাদন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতেই ঈর্ষণীয় সাফল্য আসেনি, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসসহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ব্যাপক। ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষণশীলতার বেশ বাড়বাড়ন্ত সত্ত্বেও নারীর ক্ষমতায়ন এইখানে যেই মাত্রায় ঘটিয়াছে উহার তুলনা বাস্তবিক অর্থেই বিশেষত উন্নয়নকামী দেশসমূহে কমই আছে। এই সকল কিছু মিলাইয়াই বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের নিকট হইতে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাইয়াছে। শুধু উহাই নহে, দেশি তো বটেই অনেক বিদেশি অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়নবিদ মনে করেন, সাম্প্রতিক দুই বৎসরের করোনা অতিমারির ধাক্কা এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট সত্ত্বেও বাংলাদেশ ঘোষিত ২০২৬ সালের মধ্যেই স্বল্পোন্নত দেশের তকমা ঝারিয়া ফেলিয়া স্থায়ীভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠিবে।
অনস্বীকার্য যে, এই সকল অর্জন সত্ত্বেও আমাদের কতিপয় মৌলিক ক্ষেত্রে আমাদের অপূর্ণতা রহিয়াছে। প্রথমত, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের অঙ্গীকার ছিল উহা অদ্যাবধি অধরাই রহিয়াছে। বরং রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান বলিতেছে, বিশেষত ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাইতেছে। যদি বলা হয়, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমাদের মসৃণ পথচলার স্বপ্নও অনেকাংশে মলিন হইয়া যাইতেছে তাহা হইলেও ভুল হইবে না। ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সহাবস্থান তো বটেই, এমনকি ভোটাধিকার নিশ্চিত করিবার ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি ক্রমে জটিল রূপ ধারণ করিতেছে। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগও বৃদ্ধি পাইতেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত উদ্বেগ ইদানীং জাতীয় পরিসর হইতে আন্তর্জাতিক পরিসরেও ছড়াইয়া পড়িয়াছে।
আমরা বিশ্বাস করি, দলমত নির্বিশেষে দেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সকলের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংরক্ষণে সরকারের প্রতিশ্রুতি কার্যকর হইবে। তবেই স্বাধীনতার অপূর্ণ স্বপ্নপূরণে সকল নাগরিক একযোগে আগাইয়া আসিবে।
মন্তব্য করুন