হকি খেলা ঢাকাতে এসেছিল ১৯০৮ সালে। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ কলকাতার ‘হোয়াইট ওয়েজ’ ডিপার্টমেন্টাল শপে হকি স্টিক দেখে ঢাকার উঠতি যুবকদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন। নবাববাড়ির ইউসুফ রেজা হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদের অলিম্পিক দলেও ঠাঁই পেয়েছিলেন। ধ্যানচাঁদের হকি দল তখন অলিম্পিক গোল্ড বারবার পেয়েই চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত না হওয়ায় ইউসুফ রেজা অবশ্য প্রাপ্ত গোল্ডমেডেল থেকে বঞ্চিত হন।

ঢাকার পিলখানায় ধ্যানচাঁদের ইউনিট ‘ঝাসি হিরোজ’ ছিল; হকি অনুশীলন করা হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে। আমার বাবা তখন বিশ্ববিদ্যালয় হকি দলের ক্যাপ্টেন। ছিলেন ‘হকি বন্ধু’। তাঁরা মাঝেমধ্যে ‘ম্যাচ’ খেলতেন ধ্যানচাঁদের দলের সঙ্গে; ৯/১০টা করে গোল খেতেন। রূপচাঁদ, ধ্যানচাঁদের ছোট ভাই, তিনিও অলিম্পিয়ান; ঝাসি হিরোজ ইউনিটেই পোস্টিং ছিল।

ঢাকার হকি ইতিহাস বেশ পোক্ত। স্বাধীনতার আগে হকি লিগে পশ্চিম পাকিস্তানের ইসলাউদ্দিনসহ বহু তারকা খেলোয়াড় খেলতেন। বিহারি খেলোয়াড়রাও দারুণ। আমরাও যে পিছিয়ে নেই, তা আব্দুস সাদেক এবং তাঁর সঙ্গী মহসীন, ইব্রাহীম সাবের, সোনা মিয়া, আশিকুল্লাহ কায়েসরা বারবার প্রমাণ করেছেন। ট্রোজান-ওয়ারে গ্রিসের অ্যাচিলি বা ট্রয়ের হেক্টরকে হোমার তাঁর লেখাতে বিভিন্ন বিশেষণে সাজিয়েছে। হকিতে আব্দুস সাদেক নিজ দেশকে নিয়ে বারবার হার না মানা মনোভাবে খেলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তেমনি দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন।

এত অর্জন নিয়ে আজকের হকি যখন দর্শক টানতে ব্যর্থ তখন অনেক কথা, অনেক প্রশ্ন উঠে আসে। হকি স্টেডিয়াম এই জনপদের ‘হার্ট’-এ অবস্থিত। যখন হকি খেলতাম, তখন খেলার পর পল্টন মাঠে বন্ধুবান্ধব নিয়ে শুয়ে-বসে বাদাম, মুড়ি বানানো খেতাম। দেখতাম, পুরো পল্টন ময়দানে শুয়ে-বসে বিশ্রাম করছে শয়ে শয়ে মানুষ। হঠাৎ কার মগজপ্রসূত আবিষ্কার– ভাড়ার টাকা লাগবে; বানাও দোকানসহ স্টেডিয়াম। হয়ে গেল স্টেডিয়াম। মাপজোখের বাছবিচার নেই; ফুটবলের জন্য দর্শক বসা কম হবে, কাকে দেওয়া যায়? হকির কোনো মাঠ নেই; কর্তাদের প্রতিবাদের সুযোগ নেই। এই স্টেডিয়াম দাও হকিকে। হকি মাঠে ঢোকার সময় গোনাগন্তিতে ৭-৮শ লোক আরাম করে দেখতে পারবে আর পশ্চিম গ্যালারি এত দূরে, তার ওপর সূর্য চোখে পড়ে ছোট্ট হকি বল দেখাই দুরূহ।

আমাদের ‘ঠ্যালা’ আছে। বহু লোক আসে, মাঠ ভরা। সেই কথা–
‘লাখে লাখে লোক মরে/ কাতারে কাতার/ শুমার করিয়া দেখি/ দশ হাজার।’

হকির এখন বাগাড়ম্বরই শেষ কথা। প্রথম বিভাগ লিগ ১২টা দল নিয়ে চলছে। আর দ্বিতীয় বিভাগ! দলবদল রোজার মধ্যে, ঈদের পর শুরু। হকি স্টেডিয়ামের পশ্চিম দিকের দর্শক যেমন বল দেখতে পায় না; আমরাও পত্রিকার খেলার পাতায় হকির খবর দেখি না। পত্রিকাতে খবর মানে প্রচার। আরে প্রচারেই তো প্রসার।
বর্তমান কমিটির মেয়াদ হচ্ছে শেষ এপ্রিল-মে তে; সরকার সিদ্ধান্ত নেবে– কমিটির মেয়াদ বাড়াবে কিনা।

হকিতে মাঝেমধ্যে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হয়।
‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা/ ক্ষুধায় আসে না নিদ/ আধমরা সেই কৃষকের ঘরে এসেছে আজ ঈদ।’
হঠাৎ হঠাৎ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট নিয়ে কী করে যে কবি নজরুল আগেই লিখলেন– তাজ্জব কী বাত!

হকি এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, ভবিষ্যৎ কে উজ্জ্বল করবে; দরকার বিকেএসপির মতো একাডেমি। সফল, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরাই যা গড়ে তুলতে পারেন।

হকির সম্ভাবনা নিয়ে সমকালেই আমি লিখেছি, আমাদের হকি দল ছন্দে আছে। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আমাদের অবকাঠামোও জরুরি। সেই দিকটা তাই ভুললে চলবে না। ক্রিকেটে আমাদের জয়ের যে ধারা রয়েছে, সেটা আমাদের যেমন ভালো লাগার, তেমনি হকি সেভাবে দৃষ্টি পেলে সাফল্যের ধারায় যুক্ত হতে পারে হকি।

মেজর (অব.) সাহাবুদ্দিন চাকলাদার: সাবেক অধিনায়ক, জাতীয় হকি দল