- মতামত
- সংলাপই সর্বোত্তম
সংলাপই সর্বোত্তম
নির্বাচনকালীন সরকার লইয়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির স্বীয় অবস্থানে অনড় থাকা, বিশেষত যখন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মাত্র আট মাস বাকি– গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার জন্য উদ্বেগজনক না হইবার কোনো কারণ নাই। আমরাও উদ্বেগের সহিত দেখিতেছি, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করিয়া তুলিতে সংলাপ ও আলোচনার সুযোগগুলি কীভাবে হাতছাড়া হইয়া যাইতেছে। বিশেষত গত ১৩ মার্চ গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংলাপের সম্ভাবনা এক প্রকার নাকচ করিবার পরদিন উহার জবাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো সংলাপ তাঁহারা করিবেন না বলিয়া গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তদীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দেওয়া বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে। উপরন্তু সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনের সংলাপের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করিয়া বিএনপি বলিয়াছে, ইহা সরকারের নূতন কৌশল। অর্থাৎ বর্তমান সরকারের সহিত প্রত্যক্ষ তো নয়ই, পরোক্ষ কোনো সংলাপও তাঁহারা করিতে অনিচ্ছুক। উদ্ভূত পরিস্থিতি উদ্বেগজনক এই কারণে যে, ক্ষমতাসীন ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ না হইবার অর্থ হইতেছে রাজনীতিকে সংঘাতের পথে চালিত হইবার ঝুঁকি আরও বাড়িয়া যাওয়া। ঐরূপ পরিস্থিতি গণতন্ত্র, শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতাকামী নাগরিকগণের কাম্য হইতে পারে না; বিশেষত যখন জাতীয় স্বার্থে সকল মহল হইতেই শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি প্রত্যাশা করা হইতেছে।
স্মরণে রাখিতে হইবে, দুই বৎসরের করোনা অতিমারির ধাক্কা এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে বিশ্বের বহু দেশের ন্যায় বাংলাদেশের অর্থনীতিও বর্তমানে গভীর সংকট মোকাবিলা করিতেছে। যাহার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তেরও প্রায় সকল অংশ কষ্টে দিনাতিপাত করিতেছে। এমনকি গত কয়েক দশকে অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ যতটুকু অগ্রগতি অর্জন করিয়াছে, উহাও অনেকাংশে ব্যর্থ হইবার শঙ্কা দেখা দিয়াছে। এমতাবস্থায় বিগত দশকসমূহের ন্যায় একাদিক্রমে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলিতে দেওয়া যাইবে না।
স্বীকার করিতে হইবে, দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক অনাস্থা ও অবিশ্বাস নূতন নহে। ইহাও অনস্বীকার্য, এই অনাস্থা ও অবিশ্বাসেরও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিদ্যমান। অধিকন্তু বিশেষত গত দুইটা জাতীয় নির্বাচন এবং অদ্যাবধি অনুষ্ঠিত অধিকাংশ স্থানীয় নির্বাচন নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার কারণে যেইভাবে বিতর্কিত হইয়াছে, উহা দুই দলের মধ্যকার দূরত্ব আরও বৃদ্ধি করিয়াছে। তবে ইহাও স্বীকার করিতে হইবে, ১৯৮২-৯০ পর্যন্ত এরশাদের প্রায় ৯ বৎসর এবং ২০০৭-০৮ পর্যন্ত সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বৎসর বাদ দিলে গত ৫২ বৎসরের অধিকাংশ সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিই পালাক্রমে দেশ শাসন করিয়াছে। উহার ফলস্বরূপ বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুইটা দলই এমন অবস্থান করিয়া লইয়াছে; উহাদের কাহাকেও তুড়ি মারিয়া উড়াইয়া দিবার সুযোগ নাই। অর্থাৎ পাস্পরিক সন্দেহ যত গভীরই হউক; দেশ ও জাতির অগ্রগতি নিশ্চিত করিতে হইলে অন্তত এই দুই দলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এই কারণেই দেশের সচেতন সকল মহলই আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া শাসক দল ও উহার প্রধান প্রতিপক্ষের মধ্যে একটা সমঝোতা দেখিতে প্রবল আগ্রহী। আর সংলাপই যে অচলাবস্থা নিরসনের সর্বোত্তম পথ– সেই কথাও সমোচ্চারিত।
তবে আশার বিষয়, দুই দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্রের বরাত দিয়া নির্বাচনের পূর্বে যে কোনো পর্যায়ে সংলাপ হইতে পারে বলিয়া আভাস দেওয়া হইয়াছে। সরকারি দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা তো স্বীকারই করিয়াছেন, বিএনপিকে বাহিরে রাখিয়া অনুষ্ঠিত নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়িবে। আমাদের ধারণা, বিএনপিও সংঘাতের পথ পরিহার করিতে চায়। এই জন্যই অদ্যাবধি পালিত প্রায় সকল কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ রাখার ব্যাপারে অন্তত দলটির নেতৃবৃন্দের প্রয়াস সকলেরই নজর কাড়িয়াছে।
আমাদের প্রত্যাশা, সরকারি দল এখনই সংলাপের পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি বিএনপিকে আলোচনা টেবিলে বসাইবার প্রচেষ্টা শুরু করুক এবং বিএনপিও দুই কদম অগ্রসর হউক। উভয় পক্ষ উন্মুক্ত মন লইয়া সংলাপে বসিলে সমাধান একটা আসিবেই– সেই ব্যাপারেও আমরা নিঃসন্দেহ।
মন্তব্য করুন