র‍্যাবের নিকট আটকাবস্থায় প্রাণ হারানো নারী সুলতানা জেসমিনকে যে প্রক্রিয়ায় আটক, জিজ্ঞাসাবাদ, হাসপাতালে ভর্তি করা হইয়াছে, উহা আমাদের দাঁড় করাইয়া দিয়াছে অনেক প্রশ্নের সম্মুখে। বস্তুত নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি দপ্তরে কর্মরত এই অফিস সহকারীকে আইনের আওতায় আনয়নের নামে এলিট ফোর্স বলিয়া পরিচিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য যে সকল প্রক্রিয়া অবলম্বন করিয়াছে, উহার প্রায় সকল ধাপেই আইনের বিধান কতখানি মান্য হইয়াছে– সেই প্রশ্ন উঠিতে বাধ্য। বিশেষত ঘটনাটির সূত্রপাত যেভাবে ঘটিয়াছে, উহা যেন টেলিভিশনের জনপ্রিয় সিরিজ ‘সিআইডি’র তৎপরতাকেও হার মানায়। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার, আটক হইবার পূর্বে কোনো মামলা বা পুলিশি অভিযোগও বাদীর পক্ষ হইতে করা হয় নাই। র‍্যাবের ন্যায় বাহিনী সমাজ ও রাষ্ট্রে কী প্রকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হইবে– উহাও একটি প্রশ্ন। স্বাভাবিকভাবেই এইরূপ প্রশ্নবিদ্ধ প্রাণহানির ঘটনা নাগরিক সমাজের মধ্যে বেদনা ও বিক্ষোভের জন্ম দিয়াছে। দেশে ক্রিয়াশীল মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থাগুলির এই ভাষ্যের সহিত আমরাও একমত– মামলা করিবার পূর্বেই আটক; অকুস্থলেই জিজ্ঞাসাবাদ ও পুলিশকে যুক্ত না করিবার এই ঘটনা সংবিধান, মানবাধিকারের মূলনীতি, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও বিদ্যমান আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমসূত্রে জানা যাইতেছে, বুধবার পূর্বাহ্ণে দাপ্তরিক কর্মে রাজশাহী হইতে নওগাঁ যাইতেছিলেন ওই বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে কর্মরত যুগ্ম সচিব এনামুল হক। পথিমধ্যে তিনি র‍্যাবের একটি টহল দলকে পাইয়া সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে কথিত প্রতারণার অভিযোগ জানান। আর টহল দলটি প্রায় তৎক্ষণাৎ প্রযুক্তির মাধ্যমে ওই নারীর অবস্থান শনাক্ত ও তাঁহাকে আটক করে। মধ্যাহ্নের মধ্যেই তাঁহাকে নওগাঁ হাসপাতাল এবং সন্ধ্যায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। তথায় শুক্রবার পূর্বাহ্ণে তাঁহার মৃত্যু হয়। আমাদের প্রশ্ন– পথিমধ্যে পাওয়া প্রতারণার অভিযোগ এইরূপ টর্নেডোর গতিতে আমলে লইয়া ততোধিক তৎপরতার সহিত একজন সরকারি কর্মকর্তাকে আটক করিবার হেতু কী? র‍্যাবের পক্ষে যদিও বলা হইতেছে, ওই নারী মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে প্রাণ হারাইয়াছেন; উহাতে নিঃসন্দেহ হওয়া কঠিন বৈকি। যে নারী প্রত্যুষে স্বাভাবিক নিয়মে নিজ দপ্তরে যাইতেছিলেন; র‍্যাবের হাতে আটক হইবার পর তাঁহার অকস্মাৎ ‘মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ’ হইল কোনো কারণ ব্যাতিরেকেই? আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ পদ্ধতি কীরূপ, উহা কমবেশি অনুমিত। সুলতানা জেসমিনের স্বজনবর্গও সংবাদমাধ্যমকে জানাইয়াছেন, দপ্তরাভিমুখে যাইবার কালেও তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ ও স্বাভাবিকই ছিলেন। রামেক হাসপাতাল পরিচালকও সোমবার সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে জানাইয়াছেন, ভর্তির সময় ওই নারীর মাথার ডানদিকে আঘাতের চিহ্ন ছিল।

আমরা মনে করি, কথিত প্রতারণার অভিযোগ সত্য হউক বা না হউক– কোনো প্রকার মামলা হইবার পূর্বেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তে আটক সুলতানা জেসমিনের এইরূপ মৃত্যু নাগরিক নিরাপত্তা ও অধিকারের ক্ষেত্রে বৃহৎ প্রশ্নবোধক চিহ্ন হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আমরা দেখিয়াছি, উচ্চ আদালত হইতেও এই প্রাণহানি লইয়া প্রশ্ন তুলিয়া বিস্তারিত তথ্যাদি তলব করা হইয়াছে। র‍্যাবের পক্ষ হইতেও গঠিত হইয়াছে একটি বিভাগীয় তদন্ত কমিটি। যদিও সংস্থাটির পক্ষ হইতে আশ্বস্ত করা হইয়াছে– কাহারও ঔদাসীন্য ও বাড়াবাড়ি থাকিলে ব্যবস্থা গৃহীত হইবে। আমরা মনে করি, এই ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় তদন্তই বাঞ্ছনীয়। আইনের চলিষ্ণুতা নিজস্ব গতিতে থাকুক– উহাও নিশ্চিত করিতে হইবে সরকার ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় হইতে। সুলতানা জেসমিনের পরিবার ও স্বজনবর্গ যাহাতে কোনোরূপ ভীতি ও হুমকির শিকার না হন, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে সর্বাগ্রে। মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যাইতেছে, তাঁহারা ইতোমধ্যে আতঙ্কগ্রস্ত। এই চিত্র কাম্য নহে। স্মরণে রাখিতে হইবে, র‍্যাবের নিকট আটকাবস্থায় এই মৃত্যুর ঘটনা এমন সময় ঘটিয়াছে, যখন সংস্থাটির কতিপয় সদস্যের কর্মকাণ্ড লইয়া স্বদেশে ও বিদেশে নানা প্রশ্ন উঠিতেছে। র‍্যাবের উচিত হইবে ব্যক্তিবিশেষের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য সমগ্র বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হইতে না দেওয়া।

বিষয় : প্রশ্নবিদ্ধ প্রাণহানি

মন্তব্য করুন