- মতামত
- বায়বীয় নহে
বায়বীয় নহে
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের বিপজ্জনক বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সাম্প্রতিক সময়ে সচেতন নাগরিকদের মধ্যে যে সকল উদ্বেগ পরিলক্ষিত হইতেছে, উহারই প্রতিধ্বনি ঘটিল মঙ্গলবার সমকাল ও ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ যৌথভাবে আয়োজিত আলোচনা সভায়। ‘বায়ুদূষণের প্রভাব: আমরা কী করতে পারি’ শীর্ষক ঐ আলোচনা সভায় অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন– বায়ুদূষণ শুধু মানুষের মধ্যে ফুসফুসজনিত রোগই সৃষ্টি করে না; শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করিবার পাশাপাশি মানবদেহে বহুমাত্রিক রোগ ও সমস্যাও সৃষ্টি করে। ঐরূপ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে এমনকি ভুক্তভোগীর জন্য প্রাণঘাতীও হইয়া উঠিতে পারে। এদিকে, যেন এই উদ্বেগকে জোরালো করিতেই মঙ্গলবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত শহরগুলির মধ্যে অন্যতম ঢাকা এবং দেশে প্রতি বৎসর সংঘটিত অকালমৃত্যুর ২০ শতাংশের কারণ বায়ুদূষণ।
আমরাও এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে একাধিকবার বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত প্রতিবেদন উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছি, পরিবেশদূষণের কারণে ২০১৯ সালে বিশ্বে ৯০ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করিয়াছে। বিশেষ উদ্বেগের বিষয়, তাহাদের মধ্যে দুই লক্ষ ছিল বাংলাদেশের নাগরিক। হতাশাজনক বিষয়, এত কিছুর পরও সরকারের পক্ষ হইতে অদ্যাবধি উক্ত দুর্যোগ হইতে মানুষকে রক্ষা করিতে জোরালো কোনো কর্মসূচি পরিলক্ষিত হয় নাই। এমনকি এই সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের একাধিক নির্দেশনাও উপেক্ষিত রহিয়াছে।
আলোচ্য সভায় বিশিষ্ট পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটার পরই ধুলাবালিকে দায়ী করেন। তিনি ইহাও বলিয়াছেন, উক্ত ধুলাবালির উৎস হইল বিধি না মানিয়া রাজধানীসহ সারাদেশে নূতন নূতন ভবন নির্মাণ। ২০২০ সালের নভেম্বরে এক আবেদনের ভিত্তিতে উচ্চ আদালত এই দুই বিষয়েই পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেক ৯ দফা নির্দেশনা প্রদান করিয়াছিলেন। কিন্তু ঢাকার আশপাশের কয়েকটি ইটভাটাকে জরিমানা আর নগরীর কিছু রাস্তায় কালেভদ্রে পানি ছিটাইয়া উক্ত কর্তৃপক্ষসমূহ উহাদের দায়িত্ব শেষ করিয়াছে। মঙ্গলবারের সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদানকালে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বায়ুদূষণ রোধে তাঁহাদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণরূপে আইনি দুর্বলতাকে চিহ্নিত করিয়াছেন। উপমন্ত্রীর ন্যায় আমরাও মনে করি, ইটভাটা, কলকারখানা কিংবা উপযুক্ততাহীন যানবাহনের মালিকদের ১৫-২০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করিয়া বায়ূদূষণ হইতে বিরত রাখা যাইবে না। এই প্রশ্নও উঠিতে পারে– বিদ্যমান আইনও কি যথাযথ ও নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রয়োগ হইতেছে?
অভিযোগ রহিয়াছে– পরিবেশ দপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের সহিত পরিবেশ দূষণকারীদের অশুভ আঁতাতই প্রতিবন্ধকরূপে ক্রিয়াশীল। আমরা অদ্যাবধি ঐ অশুভ আঁতাত ভাঙ্গিবার কোনো কার্যকর তৎপরতা লক্ষ্য করি নাই। বরং রাজধানীর স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র-ক্যাপস সম্প্রতি জানাইয়াছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাতাসে বস্তুকণা ২.৫-এর মানমাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম হইতে কমাইয়া ৫ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারণ করিলেও বাংলাদেশে সম্প্রতি পাসকৃত বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২-এ উহা প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম হইতে বাড়াইয়া ৩৫ মাইক্রোগ্রাম ধার্ক যরা হইয়াছে। অধিকন্তু তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্বন নিঃসরণের সর্বোচ্চ সীমাও উন্নত দেশের মানমাত্রা অপেক্ষা ন্যূনতম ৪ হইতে ৫ গুণ ধার্য করা হইয়াছে।
প্রকৃতপক্ষে বায়ুদূষণ, তৎসহিত সামগ্রিক পরিবেশদূষণের মাত্রা যে পর্যায়ে উপনীত এবং উহা প্রতিরোধে বিশেষত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহের উদাসীনতা যে রূপ ধারণ করিয়াছে, উক্ত বিপদ হইতে পরিত্রাণের স্বার্থে বলিষ্ঠ সামাজিক আন্দোলন গড়িয়া তোলা অত্যাবশ্যক। আলোচ্য ক্ষেত্রে উক্ত সভার বক্তাদের সহিত আমরা একমত– তরুণদেরই অগ্রসর হইতে হইবে। প্রয়োজনে দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের পণ্য বর্জন করিতে হইবে। এহেন সামাজিক আন্দোলন যে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাসমূহকেও দায়িত্ব সচেতন করিয়া তুলিবে– উহা বুঝিবার জন্য কাহারও বিশেষজ্ঞ হইবার প্রয়োজন নাই। আর বায়ূদূষণের বিপদ যে বায়বীয় নহে, উহাও বহুল আলোচিত। প্রয়োজন শুধু সকল পক্ষের উপলব্ধি।
মন্তব্য করুন