
অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের কথা। কুড়িগ্রামে কর্মরত সাংবাদিক। ২০২০ সালের এই মার্চেই কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের এক দল কর্মচারী তাঁকে হাত-পা-চোখ বেঁধে বিবস্ত্র করে পিটিয়েছিল। কারণ তিনি স্থানীয় প্রশাসনের একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। তাই কুড়িগ্রামের ডিসি তথা জেলা প্রশাসকের সব ক্রোধ তাঁর অধস্তন কর্মচারীরা বর্বর নির্যাতনের মাধ্যমে ঢেলে দিয়েছিল রিগ্যানের দেহে। নির্যাতক দলের নেতা ছিলেন তখন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (রাজস্ব) নাজিম উদ্দিন। পদটি জেলা পর্যায়ে ‘আরডিসি’ নামে পরিচিত। সেই কর্মচারী পেটাতে পেটাতে রিগ্যানকে বলেছিলেন, ‘বল– ডিসি আমার বাবা।’ রিগ্যান যে ডিসির আক্রোশের শিকার হয়েছিলেন, তিনি একজন নারী।
সেই ঘটনার ঠিক তিন বছর পর এই মার্চে রংপুরের একজন ডিসি তাঁকে ‘স্যার’ না ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ওপর চটে গেছেন। তিনিও নারী। ঘটনার শিকার বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক সাংবাদিকদের বলেছেন: আমি সামাজিক একটি বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলতে যাই। কথা শেষ হয়ে চলে আসার সময় জেলা প্রশাসককে বলি, ‘আপা ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।’ উত্তরে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এই চেয়ারে কোনো পুরুষ থাকলে তাঁকে আপনি কী বলতেন?’ আমি উত্তর দিই, ‘তাঁকে আমি ভাই বলে ডাকতাম।’ তখন জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এই চেয়ারকে সম্মান করে স্যার বলে ডাকা উচিত।’ ডিসির এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন শিক্ষক। তাই ঘটনা জানাজানি হয়।
প্রায় একই সময়ে বগুড়ায় একজন নারী বিচারক আরেক কাণ্ড ঘটান। সন্তানের স্কুলের একটি ঘটনায় সহপাঠীর অভিভাবককে তাঁর কাছে প্রকাশ্যে (কেউ বলেন পায়ে ধরে) ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন। তিন বছরের মধ্যে একই অঞ্চলের পাশাপাশি জেলায় উচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাধর নারী কর্মচারীদের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ, কথা ও কর্মকাণ্ড একটি উদ্বেগজনক পর্যবেক্ষণ।
এমনিতেই আমাদের পশ্চাৎপদ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা এখনও অনেক বিপদে। সেই জটিল বাস্তবতায়ও পুরুষের সমান তালে নারীদের এগিয়ে দিতে দুঃসাহসিক লড়াই করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই লড়াইকে অনুপ্রাণিত ও শক্তিশালী করতে প্রশাসনের নারীদের কাছে অনেক বেশি দায়িত্বশীল আচার-ব্যবহার প্রত্যাশিত। গুটি কয়েক নারীর অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড যেন পশ্চাৎপদতাকে উস্কে দেওয়ার সুযোগ না পায়– বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নারী, না পুরুষ; মুসলমান, না ভিন্নধর্মী; অমুক জেলার, না তমুক জেলার; অমুক দলের, না তমুক দলের; অমুকের লোক, না তমুকের লোক; কে উঁচু, কে নিচু, কে ক্ষমতাবান, কে দুর্বল, কে প্রভু, কে দাস, কে শাসক, কে শাসিত, কে বড়, কে ছোট– এমন আরও বিভাজিত চিন্তা থেকে আমাদের বিভক্ত সমাজকে সুস্থ করতে হলে দায়িত্বশীলদের কথাবার্তা, আচার-আচরণে পরিপক্বতা জরুরি, যা দেখে সাধারণ নাগরিকদের চিন্তা ও বুদ্ধি আলোকিত হবে।
এই নিবন্ধ মূলত রংপুরের নারী ডিসির ‘স্যার’ ডাক শোনার ব্যাকুলতা প্রসঙ্গে। জেলা ও উপজেলার সাংবাদিকদের কাছ থেকে বহু বছর ধরে শুনে আসছি, সংবাদ সংগ্রহের প্রয়োজনে ডিসি-এসপিসহ সামরিক-বেসামরিক, আধাসামরিক ও পুলিশ প্রশাসনের কোনো কোনো ক্ষমতাধর কর্মচারী তাঁদের ‘স্যার’ সম্বোধন না করলে চটে যান। তাঁরা বাজে ব্যবহার করেন, সেই সঙ্গে অসহযোগিতা এবং নানা হুমকি দেন। স্বাভাবিকভাবেই সেই সাংবাদিকরা কুঁকড়ে যান এবং এক পর্যায়ে সংবাদ সংগ্রহের স্বার্থে ‘স্যার’ ডাকতে বাধ্য হন। এসব ঘটনা জেনে ‘স্যার’ না ডাকার জন্য কদর্য ব্যবহার করা কর্মচারীদের জ্ঞান, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক রুচিবোধ নিয়ে করুণা জাগে। সাংবাদিকরা এই সংকট উত্তরণের পরামর্শ চান।
স্পষ্ট করে বলি– আমরা সাংবাদিকরা জনগণের টাকায় বেতনভোগী কর্মচারী নই। তাই কাউকে ‘স্যার’ ডাকতে বাধ্য নই। আর সাংবাদিকতায় ‘স্যার’ ডাকার সংস্কৃতি নেই। জনগণের টাকায় পরিচালিত প্রশাসনে কে কাকে কী ডাকবেন, সেটা তাঁদের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার ব্যাপার। সেগুলো নিয়ে একেক সরকারের একেক সিদ্ধান্ত থাকতে পারে। যেমন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ আমলে প্রশাসনের নিয়ম হলো– নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অধস্তনরা ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের ‘স্যার’ ডাকবেন। বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁকে ‘স্যার’ নয়; ‘ম্যাডাম’ ডাকতে হতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ম্যাডাম’ নয়, সবাই ‘স্যার’ ডাকবেন– এটাই তাঁর নিয়ম। ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ যাই হোক; কারা এসব ডাকতে বাধ্য? শুধু তাঁরা, যাঁরা জনগণের কষ্টার্জিত আয়ের টাকায় বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ন্যায্য-অন্যায্য সুখ-সুবিধা ভোগ করেন। কিন্তু তাঁরা ব্রিটিশ ঐতিহ্য থেকে পাওয়া মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির উত্তরাধিকার হিসেবে সব নাগরিকের কাছ থেকে ‘স্যার’ ডাক শুনতে চান। প্রজাতন্ত্রের (সরকারি) কর্মচারীদের সাধারণ মানসিকতা (নগণ্য সংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া) হলো– তাঁরা যার যার ক্ষমতার গণ্ডিতে নিজেকে মালিক বা প্রভু মনে করেন, আর নাগরিকদের ভাবেন তাঁদের প্রজা। ভুলে যান– এই প্রজারাই তাঁদের বেতন-ভাতা দেন, যা দিয়ে কর্মচারীদের পরিবার চলে।
ভক্তি থাকুক বা না থাকুক, আমরা পুরুষ শিক্ষকদের ‘স্যার’ ডাকি। কোনো সাংবাদিক চাইলে তা না-ও ডাকতে পারেন; সেই স্বাধীনতা তাঁর আছে। আমরা সাংবাদিকরা শেখ হাসিনাকে প্রথম থেকেই ‘আপা’ ডাকি। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার জন্য আমেরিকান সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিই গণভবনে। বসার ঘরে তিনি প্রবেশ করতেই শুরুতে হাসতে হাসতে বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলাম, “আপা, আমি কিন্তু আপনাকে ‘স্যার’ ডাকতে পারব না; আগের মতো ‘আপা’ই ডাকব।” মনে আছে, তিনিও আন্তরিকভাবে বলেছিলেন, ‘তোমাকে কে বলেছে আমাকে স্যার ডাকতে? তোমার তো আমাকে স্যার ডাকতে হবে না।’ এটা হচ্ছে আলোকিত শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতিফলন।
সরকারি প্রশাসনের কর্মচারীরা যেমন স্বাভাবিক সম্মান পাওয়ার দাবি রাখেন (যদিও অসংখ্য ভিআইপিকে দেখি নাগরিকদের কষ্ট দিয়ে ও বঞ্চিত করে সুখ ভোগ করতে), তেমনি ছোট-বড় সব কর্মচারীর কাছ থেকে দেশের প্রত্যেক নাগরিকও সম্মানজনক আচার-ব্যবহার পাওয়ার অধিকার রাখেন। নাগরিকদের ক্ষেত্রে ‘অধিকার’ বলছি এই কারণে যে, তাঁদের টাকায় সরকারি কর্মচারীরা বেতন ও অন্যান্য নৈতিক-অনৈতিক সুখ-সুবিধা ভোগ করেন। নৈতিকতার যুক্তিতর্ক তুললে আমার দৃষ্টিতে, সরকারি কর্মচারীদের উচিত সব নাগরিককে (সে যেই হোক) ‘স্যার’ ডাকা।
দেশে এক সময় সরকারি কর্মচারীদের আয়কর রিটার্ন ও আয়কর দিতে হতো না। এই নিয়ম বহু বছর হলো পাল্টেছে। এ জন্য অনেক সরকারি কর্মচারীর মনে গোস্বা জমে আছে। তাঁদের অনেককেই সুযোগ পেলে কণ্ঠে ঝাঁজ ও ঝাল মিশিয়ে বলতে দেখেছি– ‘আমরাও আয়কর দিই।’ এ কথা সত্য, কিন্তু সরকারি কর্মচারীরা বুঝতে চান না, তাঁদের আয় ও আয়করের টাকা জনগণের পকেট থেকে আসে। অর্থাৎ সরকারি কর্মচারীদের আয় ও আয়করের টাকার উৎস ‘প্রাইভেট মানি’ নয়; ‘পাবলিক মানি’। অথচ নাগরিকরা যখন সরকারি কর্মচারীদের অফিসের দুয়ারে, টেবিলে ন্যায্য কাজের জন্য যান; বিরক্তি, অবহেলা, দুর্ব্যবহার পেতে হয় এবং কাজ করাতে হলে তেল ও ঘুষ দিতে হয়। এটা স্বাভাবিক বাস্তবতা (নগণ্য ব্যতিক্রম অস্বাভাবিক)। কর, ভ্যাটসহ নানা খাতে সরকারকে দেওয়া জনগণের টাকার হিসাব থাকে। শুধু সরকারি কর্মচারীদের দেওয়া ঘুষের টাকার হিসাবটা সরকারের রাজস্ব ও অডিট শাখার কোনো খাতায় লেখা থাকে না।
কুড়িগ্রাম প্রশাসনের নির্যাতক কর্মচারীরা ২০২০ সালের মার্চে সাংবাদিক রিগ্যানকে বলেছিলেন ডিসিকে ‘বাবা’ ডাকতে। তিন বছর পর ২০২৩ সালের মার্চে রংপুরের ডিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বলেছেন, ডিসির ‘চেয়ার’কে সম্মান করে ‘স্যার’ ডাকা উচিত। সত্যি যদি কাঠ, স্টিল বা লোহার চেয়ারকে ‘স্যার’ ডাকতে হতো, তাতে দুঃখের বদলে আনন্দ থাকত। কারণ জড় পদার্থ চেয়ার আমলাদের মতো মালিক বা প্রভুসুলভ ভাব নিত না; বিরক্তি, অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য উপহার দিত না; কদর্য ব্যবহার করত না; কাজ করে দেওয়ার আশ্বাসের নামে ঘোরাত না; ঘুষ নিত না; ন্যায্য কিছু চাইতে গেলে অন্যায্য-অন্যায়-অপকার উপহার দিত না। তাই রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সঙ্গে ডিসির প্রকাশিত কথোপকথনের সূত্র ধরে বলছি, দেশের সব সরকারি অফিসের জড় পদার্থ চেয়ারকে ‘স্যার’ ডাকতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু চেয়ারগুলোতে যাঁরা বসেন, তাঁদের ‘স্যার’ ডাকতে পারব না।
প্রায়ই মজা করে বলি, দেশে একমাত্র ময়মনসিংহে কোনো চোর নেই। কারণ, ময়মনসিংহের মানুষ আঞ্চলিক উচ্চারণগত বৈশিষ্ট্যের জন্য চোর বলতে পারে না, ‘চুর’ বলে। অযাচিতভাবে আমলাদের একটা সুপরামর্শ দিতে চাই। ঘুণাক্ষরেও রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষদের ‘স্যার’ ডাকার জন্য চাপাচাপি করবেন না। কারণ, নিজেদের উচ্চারণগত আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের জন্য তারা আপনাদের স্যার ডাকতে গিয়ে ‘ষাঁড়’ ডাকবে। তাদের ‘স্যার’ শব্দের উচ্চারণ শোনায় ‘ষাঁড়’-এর মতো। বাস্তবতা অনুসারে নাগরিকরা অনুভব করেন, সরকারি প্রশাসনের কর্মচারীরা সমাজের কাউকে পরোয়া না করা ক্ষ্যাপাটে ষাঁড়ের মতোই বলশালী। সাধারণ জনগণকে হতে হবে বাধ্যগত হালের বলদের মতো তাঁদের বশংবদ। অর্থাৎ কর্মচারীদের ইচ্ছা ও চাহিদা পূরণের প্রাণী।
অবশ্য এ কথা না বললে অন্যায় হবে যে, আকস্মিকভাবে কোনো কোনো সরকারি অফিসে ‘ডুমুরের ফুল’-এর মতো বিরল কর্মচারীর দেখা মেলে, যাঁরা ভীষণ চমকে দেন। কারণ, তাঁরা ক্ষ্যাপাটে ষাঁড়ের মতো নন; ভক্তির স্যারের মতো।
ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৩।
জুলফিকার আলি মাণিক: সাংবাদিক ও বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন