দেশের নির্মাণশিল্পে শ্রমিকের নিরাপত্তা বিষয়ে বৃহস্পতিবার দৈনিক সমকালের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় যাহা উপস্থাপিত হইল, উহা যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলিলে ভুল হইবে না। সভার বক্তাদের বরাত দিয়া শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, এই খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কর্মরত থাকিলেও তাহাদের অধিকাংশেরই নিয়োগপত্র নাই। উপরন্তু নির্মাণাধীন ভবনে কর্মরত শ্রমিকদের পরিচয়ও লিপিবদ্ধ থাকে না। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিলেও নিহত শ্রমিকদের নাম-পরিচয় বাহির করা দুষ্কর। শুধু কি তাই! নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা বিষয়ে দেশের আইন, বিধি ও হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এ খাতে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজমান।

২০০৬ সালে প্রণীত জাতীয় বিল্ডিং কোডকে হালনাগাদ করিয়া প্রণীত হয় জাতীয় বিল্ডিং কোড ২০২০, যথায় দেশে ইমারত নির্মাণসংক্রান্ত সকল আইন ও বিধির কার্যকারিতা তত্ত্বাবধান করিতে বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি প্রতিষ্ঠা করার কথা। কিন্তু অদ্যাবধি এতদ্‌বিষয়ে দৃশ্যমান উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় নাই। ইহার ফল দাঁড়াইয়াছে এই, ঢাকাসহ দেশের প্রায় সর্বত্র যত ইমারত বা সুউচ্চ ভবন নির্মিত হইতেছে, অধিকাংশই উক্ত বিল্ডিং কোড মানিতেছে না এবং নির্মাণকালে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিও উপেক্ষিত। প্রতিদিন যত খবর আসে কাগজের পাতা ভরিয়া; তথা নিত্যই থাকে শ্রমিকের মৃত্যু ভবন হইতে পড়িয়া। বিদ্যুৎস্পর্শজনিত শ্রমিকের মৃত্যুও এন্তার।

শুক্রবারই সমকাল অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বৃহস্পতিবার গাজীপুরের শ্রীপুরে এক বহুতল ভবনের ছাদে রড তুলিবার কালে পার্শ্ববর্তী উচ্চক্ষমতার বিদ্যুতের তারের সংস্পর্শে মুহূর্তেই তিন শ্রমিক আগুনে ঝলসিয়া প্রাণ হারান। আরও দুঃখজনক, এই নিহত শ্রমিকদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে সংশ্লিষ্ট মালিককে বাধ্য করিতে দেশে কোনো আইন নাই। হয়তো বিদ্যমান শ্রম আইনে এই সকল ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের যে বিধান; মালিক উহাই দিয়া সকল দায় হইতে মুক্ত হইবে। দায়মুক্ত হইবার কথা এই জন্য বলা, যে ঘটনাটা স্পষ্টত শ্রমিক নিরাপত্তাবিষয়ক প্রচলিত আইন ও বিধির প্রতি মালিকের অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড; ইহাকে নিছক দুর্ঘটনারূপে ব্যাখ্যা করিবার প্রয়াস চলিবে। অধিকন্তু অতীতে এই প্রকার হত্যাকাণ্ড বহু ঘটিলেও খুব কম ক্ষেত্রেই মামলা হইয়াছে। আর তাহা হইলেও ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার পাইবার দৃষ্টান্ত নাই বলিলেই চলে।

দ্বিমত করিবার অবকাশ নাই, শ্রমিকেরা স্বীয় নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন হইলে এই প্রকার মৃত্যু বহুলাংশেই রোধ করা সম্ভব। কিন্তু ইহাও অস্বীকার করা চলিবে না, এই শ্রমিক প্রায় সকলেই স্বল্পশিক্ষিত। দেশের আইনকানুন সম্পর্কে জ্ঞান রাখা উহাদের পক্ষে কঠিন বৈকি। উপরন্তু জীবিকার তাগিদে হন্যে হইয়া ঘোরা এই শ্রমিকদের পক্ষে মালিকদের সহিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা লইয়া দরকষাকষি করাও দুরূহ। অতএব ব্যবস্থাপনার জায়গায় ত্রুটি রাখিয়া এহেন মৃত্যু প্রতিরোধ অসম্ভব বলিলেও অতিরঞ্জন শোনাইবে না। শিল্পটির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সুদৃঢ় করিয়া সংশ্লিষ্ট মালিকদের যদি প্রচলিত আইন ও বিধি প্রতিপালনে বাধ্য করিতে পারিলে পরিস্থিতির নিশ্চয় ইতিবাচক পরিবর্তন হইবে; তৎসহিত শ্রমিকদের সচেতনতাও ভালো ফল দিবে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের অধিকার লইয়া বেসরকারি পর্যায়ে যে সকল সংগঠন ক্রিয়াশীল, উহাদের সক্রিয়তা গুরুত্বপূর্ণ।

উপরোল্লিখিত মতবিনিময় সভায় একজন বক্তা সকল নাগরিকের অনুরূপ নির্মাণ শ্রমিকদেরও স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা দাবি করিয়াছেন এবং তাহা যথার্থ বলিয়া আমরা মনে করি। আমাদের প্রত্যাশা, শ্রম অধিকারকর্মীদের দাবির প্রতি সাড়া দিয়া যে সরকার প্রায় সর্বজনগ্রাহ্য জাতীয় বিল্ডিং কোড ২০২০ প্রণয়ন করিয়াছে, তাহারাই উহা বাস্তবায়নে অবিলম্বে তৎপর হইবে এবং ইহার স্বাভাবিক পরিণাম হিসাবেই নির্মাণ শ্রমিকদের বেঘোরে প্রাণ হারানো বন্ধ হইবে।