ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘ব্যবহার’

সমকালীন প্রসঙ্গ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ‘ব্যবহার’

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৩ | ২২:৪৯

নওগাঁয় সুলতানা জেসমিন নামে যে নারী র‌্যাবের নিরাপত্তা হেফাজতে মারা গেছেন, তাঁকে আটক করা হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা দায়েরের আগে এবং মামলা হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। গত ৩০ মার্চ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বয়ং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘নওগাঁয় সুলতানা জেসমিনকে যখন তুলে নেওয়া হয় তখন তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কোনো মামলা ছিল না। পরে এ আইনে মামলা করা হয়েছে। এখানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে।’ (সমকাল, ৩১ মার্চ ২০২৩)।

এখানে স্পষ্টত অপরাধ দুটি। ১. হেফাজতে মৃত্যু এবং ২. মৃত ব্যক্তির নামে এমন একটি আইনে মামলা, যেটি সংসদে পাস হওয়ার আগে থেকেই নানা ফোরাম থেকে আপত্তি জানানো হচ্ছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে আর কোনো আইন নিয়ে এত বেশি বিতর্ক ও সমালোচনা হয়নি। আইনমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, সুলতানা জেসমিনকে আটকের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এটি যদি আইনের ‘অপব্যবহার’ হয়, তাহলে ‘ব্যবহার’ কী?

র‌্যাবের হেফাজতে মৃত (নিহত) নওগাঁর একটি ইউনিয়ন পরিষদ ভূমি অফিসের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে যেদিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়, তার কাছাকাছি সময়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং সাভারে কর্মরত পত্রিকাটির স্টাফ রিপোর্টার শামসুজ্জামান এবং যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার মাহবুবুল আলম লাবলুর বিরুদ্ধেও ভিন্ন ভিন্ন সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এই আইনে মামলা হয়।

যদিও এই আইনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন। প্রশ্ন হলো, একজন সাংবাদিকের রিপোর্ট কী করে ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের মধ্যে পড়ে এবং এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে কী করে এই আইনে মামলা হয়? পুলিশ কী করে এই মামলা গ্রহণ করে এবং একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়?

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার আগে থেকেই সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, নাগরিক সংগঠন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনও আইনের অন্তত ৯টি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছিল। এই দাবিতে মানববন্ধন এবং সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও কাজে আসেনি। বরং আইনটি সংসদে পাস হয়ে যায় এবং যেভাবে আইনটির অপব্যবহার হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছিল, তা-ই হতে থাকে।

তবে সাংবাদিক ও নাগরিক সংগঠনগুলোর কোনো দাবি আমলে না নেওয়া হলেও পুলিশের একটি আপত্তি ঠিকই আমলে নেওয়া হয়। সেটি হলো, আইনের ৪৩ নম্বর ধারায় তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটি ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের অনুমোদন নেওয়ার বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অনুমোদনের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়। ফলে পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পায়।

সরকারের তরফে বারবার বলা হয়েছিল– এখনও বলা হচ্ছে যে, আইনটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। গত বছর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করার সঙ্গে সঙ্গেই কোনো সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হবে না। (সমকাল, ২১ মে ২০২২)। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই আইনটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুক পোস্ট এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই।

২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত ৪২৬টি মামলা বিশ্লেষণ করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) বলছে, এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৯১৩ জনকে। তাদের মধ্যে ১১ শতাংশের বেশি রাজনীতিবিদ এবং ১০ শতাংশের বেশি সাংবাদিক। এসব মামলায় আটক হয়েছেন ২৭৩ জন, যাঁদের মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ হচ্ছেন সাংবাদিক। গবেষণা বলছে, রাজনীতিবিদরা বেশি অভিযুক্ত হলেও আটকের তালিকায় সাংবাদিকরাই বেশি। 

এই আইনে এ পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে, তার অধিকাংশই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো বক্তব্য, মতামত অথবা সংবাদমাধ্যমে কোনো খবর প্রকাশের ফলে কোনো না কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তির কথিত মানহানির অভিযোগে। কোনো সংবাদের বিরুদ্ধে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তার প্রতিকার পাওয়ার জন্য দেশে প্রেস কাউন্সিল নামে একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আবার মানহানির প্রতিকার পাওয়ার জন্য দেশের প্রচলিত দণ্ডবিধিতেই (৪৯৯ ধারা) বিধান রয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হওয়ার পর থেকে কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো সংবাদ বা সমালোচনামূলক এমনকি রসিকতামূলক ফেসবুক পোস্টদাতার বিরুদ্ধেও মানহানির অভিযোগ এনে এমন সব ব্যক্তি মামলা করছেন, যারা সরাসরি ওই সংবাদ ও ফেসবুক পোস্টের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নন। অর্থাৎ মামলা করেছেন তাদের পক্ষে অন্য কেউ।

এই আইনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এবং যে দুর্বলতাটি রাখা হয়েছে সচেতনভাবেই, তা হলো আইনে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা’র কোনো সংজ্ঞা নেই। ফলে রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিক তার সহ-নাগরিকের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করতে পারছেন এবং এ আইনের এমনই জাদুকরি ক্ষমতা যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এমনকি মামলা হওয়ার আগেই পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার অসন্তুষ্ট হয় বা বেজার হয়, এমন কোনো সংবাদ বা প্রতিক্রিয়া প্রতিরোধই যেন এই আইনের লক্ষ্য। অর্থাৎ নাগরিকের ব্যক্তিগত সুরক্ষার কথা বলা হলেও এই আইনের মূল ফোকাস যে সেটি নয়, তা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অসংখ্য ঘটনায় প্রমাণিত।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার (মূলত অপব্যবহার) দেখে যে কারও মনে হতে পারে, এখানে ব্যক্তি বলতে শুধু ক্ষমতাবানরাই–যেটি সংবিধানের মূল চেতনার স্পষ্টতই পরিপন্থি।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক

আরও পড়ুন

×