ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

শ্রমবাজারে বিপরীতমুখী প্রবণতা

বিশ্লেষণ

শ্রমবাজারে বিপরীতমুখী প্রবণতা

রিজওয়ানুল ইসলাম

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৩ | ২২:৫২

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপের প্রতিবেদন। এটি বহুল প্রতীক্ষিত ছিল; কারণ ২০১৬-১৭ সালের পর দীর্ঘ বিরতিতে হয়েছে এই জরিপ এবং এই সময়ে শ্রমবাজারে কী ঘটেছে তা জানার জন্য শুধু যে মানুষের মধ্যে আগ্রহ ছিল তাই নয়, নীতিমালা প্রণয়নের জন্যও এ ধরনের জরিপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে যা প্রকাশিত হয়েছে তা একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন; যাতে অল্প কয়েকটি বিষয়ে উপাত্ত পরিবেশিত হয়েছে। বিস্তারিত উপাত্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অবশ্য এই প্রাথমিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কয়েকটি কথা বলা যায়।

উপরোক্ত জরিপের উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ সালের তুলনায় বেকারত্বের হার কমেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এটিকে ইতিবাচক এবং সাফল্যের নির্দেশক বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু এটিকে সুসংবাদ বলে মনে করা যায় না; কারণ বেকারত্বের যে সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়েছে (যদিও তা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও কর্তৃক স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত) এবং জরিপে যেভাবে বেকার চিহ্নিত করা হয়, তা থেকে বাংলাদেশের মতো দেশের শ্রমবাজারের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। এ সংজ্ঞায় জরিপের আগের সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করেননি কিন্তু কাজ করতে ইচ্ছুক এবং সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজছিলেন– এই তিন শর্ত পালন করলেই একজনকে বেকার বলে গণ্য করা হয়।

যেসব দেশে বেকারদের জন্য কোনো ভাতা বা সহায়তা নেই এবং তাদের একটা বড় সংখ্যা দরিদ্র, সেসব দেশে সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করেননি এ রকম মানুষের সংখ্যা কম হওয়ারই কথা। বস্তুত বাংলাদেশে প্রায় সব শ্রমশক্তি জরিপেই বেকারত্বের হার দেখা গেছে চার শতাংশের আশপাশে। এই যদি শ্রমবাজারের প্রকৃত চিত্র হয় তাহলে তা উন্নত-অনুন্নত অনেক দেশের জন্যই ঈর্ষার কারণ হবে।

প্রকৃত অবস্থা এই যে, ভালো কাজের অভাবে এবং অনেক সময় আর্থিক অনটনের কারণে অনেকেই কিছু একটা করে সামান্য হলেও উপার্জনের চেষ্টা করেন। এ ধরনের মানুষ হয়তো বেকার হিসেবে চিহ্নিত হন না; কিন্তু তাদের অনেকেই কর্মরত হলেও দরিদ্র। এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বাড়ল না কমল সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বেকারত্বের হার চার শতাংশ না কি তার চেয়ে নিচে নামল, তা থেকে তেমন কোনো উপসংহারে আসা যায় না।

বেকারত্বের উপাত্তের সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশের মতো দেশের শ্রমবাজারের অবস্থা বুঝতে হলে আরও কয়েকটি বিকল্প নির্দেশক ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, (১) ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, আধুনিক সেবা (যেমন ব্যবসা, ব্যাংক, বীমা, বাণিজ্য সেবা এবং শিক্ষা, আইন, চিকিৎসা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পেশা), পরিবহন এসব খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধির হার; (২) মোট কর্মসংস্থানে আনুষ্ঠানিক খাতের অংশ বাড়ছে কিনা; (৩) মোট কর্মসংস্থানে নিয়মিত বেতনভিত্তিক কাজের অংশ বাড়ছে কিনা; (৪) স্বনিয়োজিত কাজে আয় কেমন। আধুনিক খাতগুলোতে কর্মসংস্থান দ্রুত বাড়লেই কৃষি এবং অন্যান্য গতানুগতিক খাত থেকে উদ্বৃত্ত শ্রমের স্থানান্তরও ত্বরান্বিত হবে।

তবে যুবক শ্রেণির জন্য বেকারত্বের হারও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে; কারণ অনেকেই বিশেষ করে যাদের পরিবারের সাহায্য-সহায়তা দেওয়ার সামর্থ্য থাকে– কাজের খোঁজে বেকার থাকে। শুধু তাই নয়, যুবকদের– বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকদের পক্ষে শ্রমবাজারে প্রবেশ করা অনেক সময়ই কঠিন হয়। এসব কারণে প্রায় সর্বত্রই এই শ্রেণিতে বেকারত্বের হার গড় হারের চেয়ে বেশি এবং বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০১০ এবং ২০১৬-১৭ সালের জরিপ থেকে দেখা যায়, সে সময় যুবকদের বেকারত্বের হার বেড়েছিল। ২০২২ সালের জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কোনো উপাত্ত পরিবেশিত হয়নি; সুতরাং অবস্থার পরিবর্তন কোনদিকে হলো তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে যুব বেকারত্বের, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সম্পর্কে যেসব গবেষণা দেখা যায় তাতে আশাবাদী হওয়ার তেমন কোনো ভিত্তি পাওয়া যায় না।

২০২২ সালের জরিপে আরও দেখা গেছে, মোট কর্মসংস্থানে কৃষির অংশ বেড়েছে এবং শিল্পের অংশ কমেছে। উল্লেখ্য, এই উপাত্ত সার্বিকভাবে শিল্প খাত সম্পর্কে; ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের জন্য আলাদা উপাত্ত পরিবেশিত হয়নি। যাই হোক, এই উপাত্ত দেখে অবাক হইনি। কারণ কভিড মহামারির সময় থেকেই দেখা যাচ্ছিল, শিল্প খাতে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে আর শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। কৃষিতে ২০১৬-১৭ সালে নিয়োজিত ছিল ২.৪৭ কোটি, আর ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়ে গেল ৩.২২ কোটি। সাড়ে পাঁচ বছরে এই খাতে ৭৫ লাখ অতিরিক্ত মানুষ (যা ২০১৬-১৭ সালের তুলনায় ৩০% বেশি) যুক্ত হয়ে গেলেন কীভাবে আর সেখানকার মাথাপিছু আয়ের ওপর এই বাড়তি শ্রমশক্তির কী প্রভাব পড়েছে, তা ভেবে দেখার এবং গবেষণার বিষয়।

বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে কৃষিতে উদ্বৃত্ত শ্রম রয়েছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষি থেকে শ্রমিক শিল্প খাতে যাবে এমনটিই আশা করা হয়, সেখানে কৃষিতে নিয়োজিতের সংখ্যা বাড়া এবং শিল্পে কমা অবশ্যই বিপরীতমুখী প্রবণতা। এটি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক দুরবস্থার ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে নীতিমালার ব্যর্থতারও পরিচায়ক।

২০২২ সালের জরিপের একটি ইতিবাচক উপাত্ত নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার, যা প্রায় এক দশক স্থবির থাকার পর বেড়েছে। কিন্তু এই বৃদ্ধি কি শ্রমবাজারের ভালো অবস্থার জন্য, না কি অন্য কোনো কারণে তা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রাথমিক প্রতিবেদন থেকেই একটি কৌতূহলোদ্দীপক দিক বের হয়ে আসে। ২০১৬-১৭ সালের তুলনায় শহরে নারীর অংশগ্রহণ বেশ কমেছে (৩১% থেকে ২৩.৬%) আর গ্রামে একটা বড় উল্লম্ফন ঘটেছে (৩৮.৬% থেকে ৫০.৯%)। একদিকে শহরে নারীর অংশগ্রহণ কমে যাওয়া যেমন উদ্বেগজনক, অন্যদিকে গ্রামে এতটা বাড়া কি তাদের সুযোগ বেড়ে যাওয়ার জন্য, না কি অন্য কোনো কারণে (যেমন করোনা মহামারির কারণে স্কুল ছেড়ে ঘরে থাকা এবং পরিবারের কাজে সাহায্য করা) ঘটেছে, তা না জানলে শুধু সংখ্যাগুলো থেকে জোর দিয়ে কিছু বলা যাবে না।

ভালো নীতিমালা প্রণয়নের জন্য নির্ভরযোগ্য উপাত্ত যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি উপাত্তগুলো থেকে উপসংহারে আসার আগে তাদের যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে এবং তাদের পেছনের সম্ভাব্য কার্যকারণ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে হবে।

ড. রিজওয়ানুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ

আরও পড়ুন

×