
গত ৯ এপ্রিল সমকালে প্রকাশিত হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় ‘গ্রাম্য সালিশে প্রবাসীর স্ত্রীকে বেত্রাঘাত, চারজন গ্রেপ্তার’ শীর্ষক সংবাদটি পড়ে বেদনাহত হয়েছি। যে আশায় বুক বেঁধেছিলাম, সেখানে হতাশা দেখতে পাচ্ছি। ২০২৩ সালে এসে একজন নারীকে সালিশের নামে বেত্রাঘাত ও পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছে। সালিশের নামে মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বরতা চলতে দেওয়া যায় না। আগে প্রায়ই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হতো। বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলন এবং উচ্চ আদালতের একাধিক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের তৎপরতায় এ ধরনের বর্বর ঘটনা কমে আসায় অনেক দিন এমন খবর পাচ্ছিলাম না। ভেবেছিলাম, মানুষ সভ্য হয়েছে; সেই সঙ্গে আইনের
প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এখনও যে এক দল মানুষ সংকীর্ণ চিন্তা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, তার বহিঃপ্রকাশ দৃশ্যমান।
সমকালে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ওমান প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে এক অটোরিকশাচালকের প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে– অভিযোগ তুলে গত ৪ এপ্রিল মঙ্গলবার রাতে উপজেলার একটি গ্রামে সালিশে বিচারের নামে ওই নারীর বিরুদ্ধে শাস্তি হিসেবে ৮২টি বেত্রাঘাত ও ৮০টি পাথর নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয়। পরে নির্যাতনের শিকার নারী থানায় এসে ১৭ জন; সেই সঙ্গে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন। এর পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। অন্যরা পলাতক। চুনারুঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাশেদুল হকের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় চারজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। ওসি আরও বলেন, নারীর শরীরে বেত্রাঘাত করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সংবাদে স্বামীর উপস্থিতিতে স্ত্রীকে বেত্রাঘাত করার কথা বলা হলেও স্বামীর বক্তব্য নেওয়া হয়নি। এতে আমার কাছে সংবাদটি অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে। স্বামীকে গ্রাম্য মাতব্বররা চাপ দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়েছিলেন কিনা, কিংবা তাঁকে ভুল বোঝানো হয়েছে কিনা– পরিষ্কার করা দরকার ছিল। আমাদের সমাজে অনেক সময় স্বামীকে চাপে রেখে স্ত্রীকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কোনো পরিবারের প্রতি প্রতিবেশীর ক্ষোভ থাকলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অনেক সময় সেই পরিবারের নারী সদস্যকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। কারণ নারীকে সহজেই চারিত্রিক অপবাদ দিয়ে হেনস্তা করা যায়। নারীর কাঁধে অস্ত্র রেখে পুরো পরিবারকে হেয় করার চেষ্টা করে থাকে একটি চক্র। জায়গাজমি-সংক্রান্ত বিরোধের কারণে এমন চক্র তৈরি হয়। হবিগঞ্জের ঘটনায় এমন কিছু রয়েছে কিনা, খতিয়ে দেখা যেতে পারে। যদি কোনো ধরনের চাপ ছাড়া স্বামী তাঁর স্ত্রীকে হেনস্তার বিষয়ে প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন, এটি আরও ভয়াবহ।
কোনো গৃহবধূ যদি অনৈতিক সম্পর্কে জড়ান, তাহলে এটি পারিবারিকভাবে সমাধান হওয়ার কথা। সেখানে সমাধান না হলে আইন-আদালত তো রয়েছেই। তৃতীয় পক্ষকে সালিশের নামে বর্বরতা চালানোর অধিকার কে দিয়েছে? এটি বেআইনি তো বটেই; যারা এসব কাজ করেছে, তারা নিঃসন্দেহে ফৌজদারি অপরাধী। যেহেতু মামলা হয়েছে, আশা করব, সব আসামিকেই গ্রেপ্তার করা হবে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা নেই, তারাই এ ধরনের বর্বরতা চালাতে পারে।
যে নারীকে বিচারের নামে নির্যাতন করা হয়েছে– এই জুলুম, অত্যাচারের চিত্র কোনোদিন তাঁর স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না। তিনি চোখ বন্ধ করলেই সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখতে পাবেন। এমন অত্যাচার, অপমান ভোলা যায় না। দায়ীদের বিচার হলে সেই নারী কিছুটা স্বস্তি পাবেন। একই সঙ্গে তাঁর কাছে অভিযুক্তদের ক্ষমা চাওয়ানো উচিত।ৎ
আমরা পোশাক-আশাক, চলন-বলন অর্থাৎ বহিরাঙ্গে দিন দিন আধুনিক হচ্ছি। অথচ মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে না। কতিপয় লোকের গোঁড়ামির কারণে আমাদের অগ্রযাত্রা হোঁচট খাচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে, এক দল লোকের মাথায় এখনও মধ্যযুগীয় ভূত চেপে আছে। তারা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান-ইরান বানাতে চায়। এটিকে ভয়ংকর বললে কম হয়ে যাবে– ভয়াবহ! ধর্ম বাড়াবাড়ি করতে বলেনি। অথচ এরা নিজের মতো করে অভিযোগ সাজিয়ে আইন হাতে তুলে নিয়ে নারীরর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। ইসলাম ধর্মে নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়েছে। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। কতিপয় ব্যক্তি সেই নারীর প্রতি বর্বরতা চালাচ্ছে।
নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা নারী। এটিকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু দু’চারজন নারীর অবস্থান তৈরি হলেই সমাজ থেকে নারীবিদ্বেষ চলে যাবে না। তাই পুরো সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। চিন্তায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা মাঝেমধ্যে দেখি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়া হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব ব্যক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। হয়তো রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে এটি করা হচ্ছে। কিন্তু এর পরিণাম শুভ হবে না। কারণ সাম্প্রদায়িক শক্তি, ধর্মান্ধ ব্যক্তি কখনোই গণতন্ত্রের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। তাদের সঙ্গে আপসের পরিণাম আত্মঘাতী। কোনো ধর্মেই কাউকে আঘাত করার কথা বলা হয়নি। ধর্মপ্রাণ আর ধর্মান্ধ এক কথা নয়। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি নারীকে অপমান করতে পারেন না। ধর্মান্ধরাই পারে বর্বরতা চালাতে; বিচারের নামে প্রহসন করতে। সময় এসেছে এসব অপশক্তিকে শক্ত হাতে দমনের। তা না হলে যে বর্বরতা সমাজ থেকে মুছে গিয়েছিল, তা আবার ছড়িয়ে পড়তে পারে।
প্রবাসী ব্যক্তির স্ত্রীকে নিয়ে সমাজে নানা ধরনের কানাঘুষা চলে। এটি একটি ব্যাধি। স্বামী বিদেশে থাকলেই স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানসিকতা যাদের, তারা ভালোমানুষ হতে পারে না। উদ্দেশ্যমূলক নানা ধরনের কুৎসা রটানো হয়। শুধু যে বিদেশে কাজে গেলে স্ত্রীকে অপবাদ শুনতে হয়; এমন নয়। যে নারীর স্বামী ঢাকায় কাজ করেন, তাঁকেও কথা শুনতে হয়। রাজধানীতে যেসব নারী একা বা সন্তান নিয়ে বসবাস করেন, তাঁদেরও এসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অনেক বাড়িওয়ালা এসব নারীর কাছে বাড়ি ভাড়া দিতে চান না। আগেও বলেছি– সমস্যা হচ্ছে চিন্তা-চেতনায়। এহেন সংকীর্ণ চিন্তার শিকড় অনেক গভীরে। এর মূলোৎপাটনে রাষ্ট্রকে যেমন ফতোয়াবাজির নামে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া লোকদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে, তেমনি এসবের বিরুদ্ধে জোরদার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এলাকায় সামাজিক কমিটি করে সাধারণ মানুষকে এসব বিষয়ে সচেতন করতে হবে।
খুশী কবির: সমন্বয়ক, নিজেরা করি
মন্তব্য করুন