- মতামত
- পাহাড় যেন চলে এসেছে ভাটায়
পাহাড় যেন চলে এসেছে ভাটায়

প্রথম দেখায় মনে হবে যেন পাহাড় চলে এসেছে ইটভাটায়। হাত-পা না থাকলেও টুকরো টুকরো করে ছয় ও দশ চাকার ট্রাকে ভরে পাহাড় স্থানান্তর করা হয়েছে। পাহাড় প্রকৃতির আশীর্বাদ। আইনে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ। তবুও লাল মাটিতে কালো হাতের থাবা চলছে জোরেশোরে। পুরো রমজান মাস মাটিখেকোদের তাণ্ডব চলে ঘাটাইল উপজেলার পূর্ব এলাকা মধুপুর ও ভাওয়াল গড়ে। এতে ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, লক্ষ্মীন্দর ইউনিয়নের ফটিয়ামারী এলাকায় টানা দুই মাস ধরে চলছে পাহাড় কাটা। এ কাজে জড়িত দুলালিয়া গ্রামের মো. দুলাল ও আব্দুল জলিল, মধুপুরচালা গ্রামের দেলোয়ার হোসেন, ফজর আলী ও জুব্বার আলী। আকাশ ও সাগর নামে দুটি ইটভাটায় শেয়ার রয়েছে মো. দুলালের। কৌশলে মোবাইল ফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কথার একপর্যায়ে ফটিয়ামারী পাহাড় কাটতে আর কতদিন লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সপ্তাহখানেক হলেই শেষ হবে।
একই ইউনিয়নের মুরাইদ ও সাপমারা এলাকায় পাহাড় কাটা হচ্ছে। মুরাইদ এলাকায় পাহাড় কাটার নেতৃত্বে রয়েছেন মাস্টারবাড়ি এলাকার লেবু মিয়া এবং চকপাড়া গ্রামের সাদিক মিয়া। সাপমারা এলাকায় পাহাড় কাটার কাজে জড়িত ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার চানু মিয়া ও শিরু মিয়া, মুরাইদ গ্রামের গোলাপ হোসেন। স্থানীয়দের ভাষ্য, তাঁদের পেশাই নাকি পাহাড় কাটা। গোলাপ হোসেন জানান, মাসখানেক সময় পেলেই মাটি কাটা শেষ করা যাবে।
লক্ষ্মীন্দর ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান চলতি বছর আকাশ ব্রিকস নামে একটি ইটভাটার শেয়ার নিয়েছেন। পাহাড়ি লাল মাটি কেটে নিয়ে সেই ভাটায় বিশাল স্তূপ করা হয়েছে। যা দেখে মনে হতে পারে পাহাড় চলে এসেছে ইটভাটায়।
অথচ তাঁর ভাষ্য, ‘তাঁর ইউনিয়নে কোনো পাহাড় কাটা হয় নাই।’
রসুলপুর ইউনিয়নের শালিয়াবহ ও নয়াপাড়া এলাকায় পাহাড় ধ্বংসে মেতে উঠেছে একটি চক্র। স্থানীয়দের দাবি, নয়াপাড়া অংশে পাহাড় কাটেন আব্দুল কদ্দুস ও হাজী নামে একজন। হাজীর প্রকৃত নাম বাদশা মিয়া। বাড়ি শেরপুর জেলায়। হাজী জানান, মাটি যায় সিরামিক কোম্পানিতে। কোম্পানি বর্তমানে বন্ধ, তাই আর কাটা হচ্ছে না।
সংগ্রামপুর ইউনিয়নের খাগরাটা এলাকায় কিরণমালা বাজারের পাশে বিশাল দুটি পাহাড় কাটা প্রায় শেষ। স্থানীয়রা জানান, রমজানের শুরুতেই শুরু হয়েছিল এ তাণ্ডব। এতে জড়িত সাবেক ইউপি সদস্য বাইচাইল গ্রামের মিলন মিয়া ও শহিদুল ইসলাম টিক্কা। কিরণমালা বাজারের পাশে পাহাড় কাটা কি শেষ? জবাবে মিলন বলেন, ‘শেষ হয় নাই। কয়েকদিন পর আবার শুরু হবে।’
সংগ্রামপুর ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন বাবু জানান, পাহাড় কাটা হয় রাতে। এখন পর্যন্ত পরিষদের দায়িত্ব না পাওয়ায় প্রশাসনকে বিষয়টি জানাতে পারেননি বলে দাবি তাঁর।
সন্ধানপুর ইউনিয়নের মুন্সিগঞ্জ বাজারের পাশে এবং পলাশতলী গ্রামে টিলা কাটা হচ্ছে। পলাশতলী গ্রামে ওই কাজের জড়িত স্থানীয় মিনাল হোসেন, বাবু, মো. রফিক ও সোহেল। মুন্সিগঞ্জ বাজারের পাশে তিন জায়গায় পাহাড় কাটা হয়েছে। এর সঙ্গে কারা জড়িত বলতে পারেন না স্থানীয়রা।
সন্ধানপুর ইউপির নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ‘পাহাড় কাটার বিষয়ে কিছু জানি না। এখনও দায়িত্ব বুঝে পাইনি। দায়িত্ব পেলে এ বিষয়ে কাজ করা হবে।’
ইটভাটা মালিক সমিতির তথ্যমতে, উপজেলায় ভাটার সংখ্যা ৪৫টি। আগামী মৌসুমে ইট তৈরির জন্য এ বছরই মাটি কেটে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে।
একাধিক ইটভাটার মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাল মাটির সঙ্গে মেশানো হয় বালু। সঙ্গে প্রয়োগ করা হচ্ছে খৈল, টিএসপি ও ইউরিয়া সার। এরপর ভেকু (খননযন্ত্র) দিয়ে ওলটপালট করে স্তূপ করে রাখা হয়। নিচু জমি ভরাট কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে লাল মাটি। উপজেলার পেচারআটা মোড়ে প্রায় দশ ফুট গভীর থেকে বিশাল আকারের একটি জায়গা ভরাট করা হয়েছে পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে। অথচ ওই স্থান থেকে ধলাপাড়া ফাঁড়ির দূরত্ব অর্ধকিলোমিটারও হবে না।
টাঙ্গাইল পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জমীর উদ্দিনের ভাষ্য, পাহাড় কাটার বিষয়ে তাঁদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নিয়মিত মামলা করা হচ্ছে। তবে রমজান মাসে ঘাটাইলে কোনো মামলা হয়নি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার সমকালকে বলেন, পাহাড় কাটার ফলে ওই এলাকায় ভূমিকম্প বেশি হবে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ে ভূমিধসে জানমালের ক্ষতি হবে। পরিবেশ ভারসাম্য হারাবে। পাহাড় কাটা বন্ধে প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিয়া চৌধুরী জানান, রমজান মাসে পাহাড় কাটার বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারেননি তাঁরা। তবে এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া মাত্রই সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পাহাড় কাটা বন্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, গত ১২ ফেব্রুয়ারি জেলা আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক সভায় পুলিশ সুপার পাহাড় কাটায় জড়িতদের সরাসরি ধরে পুলিশকে বাদী হয়ে মামলা করতে নির্দেশ দেন। তবে এটা বন্ধে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে ঘাটাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজহারুল ইসলাম সরকার সমকালকে বলেন, ‘আমরা পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িতদের ধরে মামলা দিচ্ছি। আমাদের যেখানে যতটুকু করার ততটুকু করছি।’
মন্তব্য করুন