
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে সংস্থাটির সদরদপ্তরে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের অংশীদারিত্বের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক অনুষ্ঠান হয়; সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসকে পদ্মা বহুমুখী সেতুর একটি ছবি উপহার দেন। সোমবার থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটি অনেকের টাইমলাইনে ঘুরছিল। মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও তা খবর হয়েছে।
ছবিটির বার্তা বহুবিধ এবং অনেকেই মনে করছেন, এটি মধুর প্রতিশোধ। কারণ ২০১২ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ বাতিল করেছিল বিশ্বব্যাংক; যদিও বিশ্বব্যাংক তার দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি এবং ২০১৭ সালে কানাডার আদালতেও তা প্রমাণ করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু থেকেই এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আসছিলেন। পরে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয় পদ্মা সেতু, যা গত বছরের ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয়েছে।
বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে এ সুদীর্ঘ সময়ে এর আগে বা পরে তেমন তিক্ততা দেখা যায়নি। এর আগে বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু বা যমুনা সেতুতে অর্থায়ন করেছিল সংস্থাটি। এমনকি পদ্মা সেতুকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক কর্মযজ্ঞে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা আরও বেড়েছে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর চলমান সফরেই আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগ, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার পাঁচটি উন্নয়ন প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ২২৫ কোটি মার্কিন ডলার তথা প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
পদ্মা সেতুর অর্থায়নে ২০১০ সালে আগ্রহ দেখায় বিশ্বব্যাংক। সে অনুযায়ী এ সেতুর জন্য ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। একই বছর জাইকা, আইডিবি ও এডিবির সঙ্গেও পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আসে দুর্নীতির অভিযোগ। সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল সংস্থাটির। অবশেষে ২০১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। নিয়ম অনুসারে অন্যান্য সংস্থাও সেখান থেকে সরে আসে। এর পর প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিয়ে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উড়িয়ে দেন এবং তখনই নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। অবশেষে বাংলাদেশ তার সক্ষমতা দেখিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ছাড়াই ৩০ হাজার কোটি টাকার এ বিশাল পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ। বস্তুত বিশ্বব্যাংক ছাড়া তখন বিশাল এ সেতুর কথা চিন্তা করা এতটা সহজ ছিল না। অথচ বাংলাদেশ সেই অসাধ্য সাধন করেছে। তাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন সেতুটি করে দেখিয়ে তার ছবি বিশ্বব্যাংকে নিয়ে যান এবং সংস্থাটির প্রধানকে উপহার দেন, সেটি একদিকে যেমন বাংলাদেশের গৌরবের প্রতীক, অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক ছাড়াই বাংলাদেশ যে তা করে দেখিয়েছে– সে অর্থে এক ধরনের মধুর প্রতিশোধও বটে। সে জন্য আমরা দেখেছি, ওই অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস স্বীকার করেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন সাফল্য থেকে অনেক দেশ শিক্ষা নিতে পারে।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য জরুরি ছিল। এটি বলা চলে, ১৯টি জেলাকে যুক্ত করেছে। এর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, পর্যটন ও শিল্প বিকাশের অবারিত সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে ইতোমধ্যে রেললাইনও সংযুক্ত হয়েছে। সড়কপথের পাশাপাশি রেলপথ চালু হওয়ার মাধ্যমে যোগাযোগের নতুন দিগন্তে সামগ্রিক অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সে জন্য মানুষের স্বার্থেই সেতুটি জরুরি ছিল। আর বিশ্বব্যাংককে যে বার্তা দেওয়ার দরকার ছিল, সেটা গত বছর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমেই সংস্থাটি পেয়ে গেছে। তবু সোমবার প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুর ছবি নিয়ে গেছেন। এ উপহারের মধ্যে রয়েছে প্রতিশোধের বার্তাও। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ছবিটি দেখে তাদের ভুল বুঝুক এবং বাংলাদেশের সঙ্গে তারা যে অন্যায্য কাজ করেছে; তা যেন অন্যদের সঙ্গে না ঘটে– এটাই কামনা।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com
মন্তব্য করুন