ঢাকা বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪

বাজার

গোমাংসের দাম ও আমদানির প্রশ্ন

গোমাংসের দাম ও আমদানির প্রশ্ন

হাসান মামুন

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৩ | ১৮:০০

রমজানের আগ দিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি গোমাংসের কেজি কেন ৭৫০ টাকা– যেখানে দুবাইয়ে আমদানি করা গোমাংস ৫০০ টাকায় পাওয়া যায় বলে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল, বিদ্যমান ব্যবস্থাপনায় এর দাম হয়তো আরও বাড়বে। দাম কমাতে গোমাংস আমদানি করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। এও বলেছিলেন, লোকে ‘ন্যায্য দামে’ জিনিস কিনতে না পারলে ‘ইন্ডাস্ট্রি’র কথা ভেবে কী হবে?

ভেবে একটু অবাক লাগছিল– তিনি কি জানেন না, ইতোমধ্যে ‘গোমাংস’ আমদানি হচ্ছে? যদিও ভারত থেকে সীমান্তপথে গরু আসা প্রায় বন্ধ। চোরাপথে গরু আসার পর এপারে যেভাবে ‘রাজস্ব’ আদায় করে ক্রেতার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো, সেটা ছিল এক আশ্চর্যজনক ব্যবস্থা। তবে এতে গোমাংসের দাম অন্তত সহনীয় ছিল। এর পর থেকে অব্যাহতভাবে দাম বাড়ছে। সমকালের এক প্রতিবেদনমতে, গত সাত বছরে গোমাংসের দাম বেড়েছে ১৪২ শতাংশ!

ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ায় দেশে গরু পালন অবশ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত কয়েকটি কোরবানির ঈদে দেশি গরু-ছাগল দিয়েই মেটানো গেছে এর বিপুল চাহিদা। কোনো কোনো ঈদে কিছু গরু-ছাগল অবিক্রীতও থেকে যায়। কর্মসংস্থান ও আয়ের দিক থেকে দেখলে এটা বড় ঘটনা। শিক্ষিত তরুণের একটা অংশও গরু-ছাগল পালনে লেগে পড়েছে। তাদের কিছু ঋণ সহায়তা আর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সরকার। করোনার মধ্যেও গরু-ছাগলের পাশাপাশি গারল ও গয়াল পালন বেড়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার কিছু গোমাংস রপ্তানির কথা ভাবছে বলেও খবর ছিল।

বাস্তবে কয়েক বছর ধরে ‘গোমাংস’ আমদানি হচ্ছে এবং এর পরিমাণ অনুল্লেখযোগ্য নয়। সমকালেই সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রতিবেদন পড়েছি। তাতে নিয়মনীতি না মেনে আমদানি; পাশাপাশি চোরাপথে গোমাংস আসা এবং প্রধানত রেস্তোরাঁয় তা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার খবর ছিল।

অপেক্ষাকৃত কম দামে বিক্রি হওয়া এসব মাংস প্রধানত মহিষের। চোরাপথে আসা মাংস যেভাবে নানা হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে পৌঁছে, তাতে মান রক্ষিত হওয়ার কথা নয়। কিছু নমুনা পরীক্ষায় এ ধারণার পক্ষেই মিলেছে সমর্থন। তবে বিধিবদ্ধ উপায়ে আমদানি হওয়া ফ্রোজেন মাংস মানসম্মত হওয়ার কথা। ভারত বা যেখান থেকে এগুলো আনা হয়, সেসব উৎসের প্রতিষ্ঠান মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে মাংস রপ্তানি করে থাকে। মাংস রপ্তানিকারক হিসেবে ভারত আছে তালিকার শুরুতেই। মহিষের মাংস রপ্তানিতে দেশটি বলা যায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সুতরাং, সেখান থেকে কম দামে আসা মাংস মানসম্মত হলে আপত্তির কী আছে?

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গরুতে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছি হয়তো; কিন্তু ভোক্তার দিক থেকে দেখলে এতে সুফল মিলছে না। কারণ গোমাংসের দাম বাড়ছে লাফিয়ে এবং মানুষ অগত্যা এটা খাওয়া কমিয়ে দিয়ে ব্রয়লার মুরগির দিকে ঝুঁকছে। গত ঈদে গোমাংসের দাম শহরাঞ্চলে ৮০০ টাকা কেজি হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের দিকেও দাম বাড়ে লাফিয়ে। হঠাৎ চাহিদার বৃদ্ধিতেই এমনটা ঘটেছিল বৈকি। সমস্যা হলো, এমনিভাবে গোমাংসের দাম বাড়ার পর তা আর কমতে দেখা যাচ্ছে না। খাসির মাংসের দামের সঙ্গে এর আগেকার তফাতও অনেক কমে এসেছে। এভাবে দাম বাড়ার প্রধান কারণ নিশ্চয় গরু পালন ব্যয় বেড়ে যাওয়া। তৃণভূমি কমে যাওয়া এবং অল্প জায়গায় বিকল্প খাদ্য খাইয়ে গরুকে প্রস্তুত করায় এর পেছনে ব্যয় অনেক বেড়েছে। গরু পালনে নিয়োজিতদের মজুরিও কম নয়। কাজটি কষ্টকর এবং বিশেষায়িত অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন। গরুর পরিবহন ব্যয়ও কম নয়। জ্বালানি তেলের বিরাট দাম বৃদ্ধি এতে ভূমিকা রাখছে। একাধিক হাতবদল এবং পথঘাটে চাঁদাবাজির কারণে সর্বশেষ ক্রেতাকে বেশি দামেই কিনতে হয় গরু। শহরাঞ্চলে ক্রমবর্ধমান দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল প্রভৃতির কারণেও গোমাংস বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি কমে যাওয়ায় বিক্রেতার সংখ্যা হ্রাসের ঘটনাও আছে। এদিকে পোষাতে না পেরে গরুর বেশ কিছু খামার নাকি বন্ধ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় গোমাংসের চাহিদা ও জোগানের বর্ণিত ভারসাম্যটি এখনও অটুট কিনা, কে জানে!

ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ‘গোমাংস’ পরিভোগ হচ্ছে নিশ্চয়ই। অপেক্ষাকৃত কম দামে এভাবে চাহিদা মিটলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাও কঠিন। এফবিসিসিআই সভাপতি নিজেই যেখানে বলছেন প্রয়োজনে মাংস আমদানির কথা! তিনি সম্ভবত আমদানি বাড়ানোর কথা বলছিলেন। গোমাংস আমদানিতে কিছু শর্ত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত খবরে আবার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কী করবে তা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তিতে আছে সরকার। আমদানিকারকরা ২০% সম্পূরক শুল্ক দিয়েও অপেক্ষাকৃত কম দামে গরু বা মহিষের মাংস জোগাতে পারছে। তারা এখন বলতে পারে, এ ক্ষেত্রে চোরাচালান রোধ করে সহজে আমদানি করতে দেওয়া হোক। তাহলে অভিজাত হোটেল ও চেইন শপের চাহিদা মিটিয়েও সাধারণ মানুষের জন্য তারা মাংস জোগাতে পারবে। এতে গোমাংসে অভ্যস্তদের আমিষের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে একটা অগ্রগতি হবে।

দেশে ইতোমধ্যে গড়ে ওঠা গরু পালন খাতটি কি তাহলে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে না? দক্ষ হয়ে উঠে প্রতিযোগিতায় টেকার জন্য তাদের কি আরও সময় দেওয়া প্রয়োজন নয়? ভারত থেকে গরু আসা বন্ধের পর স্থানীয়ভাবে কম খরচে গোসম্পদ উৎপাদনে সরকার কী সহায়তা জুগিয়েছে, তার পর্যালোচনা এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন। মহিষের উৎপাদন কিন্তু মোটেও সন্তোষজনক নয় এবং এর সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। দেশি মহিষ জবাই হলে এর মাংসের দাম তাই পড়ছে গরুর চাইতে বেশি। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির দায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নিতে হবে। মহিষের মাংস ও দুধ নানাদিক বিচারে গরুর চেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে প্রচারণা রয়েছে। সে কারণেও নাকি মহিষের চাহিদা উঠছে বেড়ে। মানসম্মত মহিষের মাংস আমদানি হয়ে এলে এবং সহনীয় দামে প্রকাশ্যে বিক্রি হলে অনেক ক্রেতাও মিলবে।

এ পরিস্থিতিতে সব দিক বিবেচনায় দেশীয় পশুপালন খাত সুরক্ষিত রেখেই কীভাবে ক্রেতাস্বার্থ সংরক্ষণ করা যায়, সেটি বের করতে হবে সযত্নে। বাংলাদেশের মতো আয়ের দেশে যে দামে গোমাংস কিনে খেতে হচ্ছে, তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাস্থ্যগত কারণে গোমাংস খাওয়া কমে যাওয়া এক কথা; কিন্তু শুধু দামের কারণে এটা ঘটা বেদনাদায়ক। কম দামে আমদানি করা গরু ও মহিষের মাংস এ ক্ষেত্রে হতে পারে একটি বড় বিকল্প। গরু পালনকারীদের স্বার্থ একেবারে জলাঞ্জলি না দিয়ে এ ক্ষেত্রে একটি ‘হাফ-ওয়ে’ বের করার সময় বোধ হয় এগিয়ে এসেছে।


হাসান মামুন: সাংবাদিক, বিশ্লেষক

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×