দেশের শ্রম আদালতসমূহে মামলাজটের যে চিত্র সোমবার সমকালের এক প্রতিবেদনে তুলিয়া ধরা হইয়াছে, উহা যেকোনো মানদণ্ডেই অনাকাঙ্ক্ষিত বলিয়া আমরা মনে করি। প্রতিবেদন অনুসারে, শ্রম আদালতসমূহে বর্তমানে বিচারাধীন ২৪ সহস্রাধিক মামলা। কিন্তু গত ছয় মাসের অধিক সময় ধরিয়া মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষাধীন ১৯ সহস্রাধিক। অর্থাৎ মোট মামলার প্রায় ৮২ শতাংশই অনিষ্পন্ন। এই অবস্থা মামলাকারী শ্রমজীবী মানুষদের দুর্ভোগ যেমন প্রলম্বিত করিয়া চলিয়াছে, তেমনি শিল্প খাতের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক বজায় রাখিবার পক্ষেও আদৌ সহায়ক নহে।

সাধারণত বকেয়া বেতন-ভাতা আদায়, চাকরিতে পুনর্বহাল, ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন অভিযোগে দেশের শ্রম আদালতগুলিতে মামলা করিয়া থাকেন শ্রমজীবীরা। এই সকল বিষয়ের প্রতিটিই সংশ্লিষ্ট মামলাকারীর জীবন-জীবিকার সহিত নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। ফলে মামলা নিষ্পত্তিহীন অবস্থায় পরিবার-পরিজন লইয়া সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের সম্মুখে মানবেতর জীবনযাপন ব্যতীত কোনো বিকল্প থাকে না। অধিকতর দুর্ভাগ্যজনক, এহেন পরিস্থিতি নূতন নহে। বহু যুগ ধরিয়া বিরাজমান, কিন্তু কার্যকর সমাধানের প্রয়াস দৃষ্টিসীমার বাহিরে। ইহা সত্য, মামলাজট হ্রাস করিতে চার বছর পূর্বে দেশে শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া ১০টি করা হয়। উপরন্তু অদ্যাবধি সচল না হইলেও সরকার নূতন তিনটি শ্রম আদালত গঠন করিয়াছে। কিন্তু বাস্তবতা হইল, বিদ্যমান আইনে শ্রম আদালতে ৬০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পন্নের কথা থাকিলেও এক যুগ পূর্বের মামলাও দেশের শ্রম আদালতসমূহে বিচারাধীন এবং বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।

আমরা মনে করি, শ্রম সংক্রান্ত মামলাজটের কারণ নিছক আদালতের সংখ্যাল্পতা নহে। প্রথমত, আদালতে মামলা অনুপাতে জনবল বৃদ্ধি পায় নাই। দ্বিতীয়ত, সাধারণত শ্রম অধিকারবিষয়ক মামলা সম্পর্কে অনভিজ্ঞ বিচারককে প্রেষণে শ্রম আদালতে নিয়োগ দেওয়া হয়, যিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রম আদালতের বিচারকার্য পরিচালনায় দক্ষতা অর্জন করিবার পর স্বাভাবিক নিয়মেই অন্যত্র বদলি হইয়া যান। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়। তৃতীয়ত, শ্রম আইনের বেশ কিছু ধারার মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সমন্বয়ে আদালত গঠন করিতে হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ধার্য তারিখে নির্দিষ্ট প্রতিনিধির অনুপস্থিতির কারণে মামলা নিষ্পত্তি করা যায় না। চতুর্থত, অধিক্ষেত্রজনিত কারণে অধিকাংশ মামলাই করা হয় ঢাকার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রম আদালতে। ফলে একজন বিচারকের পক্ষে বিপুলসংখ্যক মামলার চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। তদুপরি এই সকল আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের জন্য দেশে মাত্র একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল, যাহা ঢাকায় অবস্থিত। ফলে বিচারিক আদালতে মামলার নিষ্পত্তি হইলেও আপিল পর্যায়ে গিয়া উহা আটকাইয়া যায়। আবার অনেক শ্রমিক বিশেষত দূরত্ব ও ব্যয়বহুলতার কারণে ঢাকায় আসিয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করিতে উৎসাহ পান না। একই সঙ্গে ইহাও বলা দরকার, বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শ্রম আদালত ও আপিল ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত রায়ের উপর উচ্চ আদালতে রিটের মাধ্যমে স্থগিতাদেশ লইয়া বছরের পর বছর মামলা ঝুলাইয়া রাখে।

এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি, শ্রম অধিকার বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিবর্গ এবং অংশীজনের সহিত পরামর্শক্রমে বিদ্যমান শ্রম আইন এবং বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ সংশোধন জরুরি হইয়া পড়িয়াছে, যাহার মাধ্যমে অন্তত মামলার শুনানি অব্যাহত রাখিবার পথে আইনি জটিলতা পরিহারের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং অধিক্ষেত্র অনুসারে আদালতের সংখ্যার পাশাপাশি জনবলেরও বিন্যাস করা যায়। একই সঙ্গে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য এডিআর তথা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াকেও অধিকতর গতিশীল করা প্রয়োজন। শিল্পক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিক সংঘাত পরিহার করিয়া শান্তিপূর্ণ উৎপাদন নিশ্চিতকরণের স্বার্থেই যেহেতু শ্রমিকদের জন্য ন্যায়বিচার জরুরি; শ্রম আদালতে মামলাজট সার্বিক উৎপাদন ব্যবস্থার জন্যও নেতিবাচক। মামলাসমূহের দ্রুত নিষ্পত্তি না হইলে শ্রম আদালত লইয়া সকল উদ্যোগ ও প্রত্যাশা পণ্ডশ্রম হইতে বাধ্য।