ঘুমিয়ে থাকায় টের পাইনি। কিন্তু আজকাল ঘুমন্ত বা অন্যমনস্ক কেউ ভৌগোলিকভাবে টের না পেলেও সামাজিক মাধ্যম জানিয়ে দেবেই– আশপাশে কোথাও ভূমিকম্প হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার সকালের ফেসবুকও তাই ছেয়ে গিয়েছিল সংবাদ ও শঙ্কায়; ভোর ৫টা ৫৭ মিনিট ৮ সেকেন্ডে ঢাকা ও সংলগ্ন অঞ্চলকে ঝাঁকুনি দিয়েছে ৪ দশমিক ৩ মাত্রার একটি ভূমিকম্প।

ভৌগোলিক কাঠামোর কারণেই এই নীল গ্রহের জন্য ভূমিকম্প অস্বাভাবিক নয়। আক্ষরিক অর্থেই প্রতিনিয়ত পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ভূমিকম্প হচ্ছে। যেমন শুক্রবার ভোরের ভূমিকম্পের খবর প্রথম দিয়েছে যে মার্কিন সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস জিওলজিক্যাল সার্ভে-ইউএসজিএস, তারাই ৫ মে (২০২৩) সন্ধ্যা ৭টার দিকে দেখাচ্ছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বজুড়ে অন্তত ৪৬টি এমন ভূমিকম্প হয়েছে, যেগুলোর মাত্রা ২ দশমিক ৫-এর বেশি। বাংলাদেশের ভূমিকম্পটির পর বিশ্বজুড়ে ২ দশমিক ৫ মাত্রার বেশি আরও অন্তত ৩৫টি ভূমিকম্প ঘটেছে। এর মধ্যে অন্তত ১৬টি রয়েছে ৪ মাত্রার বেশি। বলা বাহুল্য, ২ দশমিক ৫ মাত্রার কম রয়েছে আরও অসংখ্য। স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্পে যদিও ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয় না; বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, একই এলাকায় এ ধরনের ঘন ঘন ছোট ছোট ভূমিকম্প আসলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস।

শঙ্কার বিষয় হলো, কয়েক মাস ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কিছুদিন পরপরই স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প হচ্ছে। একটি পরিসংখ্যান বলছে, কেবল মার্চ ও এপ্রিল মাসেই দক্ষিণ এশিয়ায় ২ দশমিক ৫ মাত্রার ওপরে ১০টির বেশি ভূমিকম্প হয়েছে। বলা বাহুল্য, সবই ঢাকায় বসে অনুভূত হয়নি। মনে আছে, ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ছিলাম নেপালের কাঠমান্ডুতে। নিজেরা টের পাইনি; দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে যে ভূমিকম্প হয়েছে। সেটা জেনেছিলাম ঢাকা থেকে যাওয়া ফোনে।

এবারের ভূমিকম্প দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ আগের মতো হিমালয় পর্বতমালার শাখা-প্রশাখায় নয়; এর উৎস ঢাকা জেলার ভেতরেই; দোহারে। আগারগাঁওয়ের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে; ভূপৃষ্ঠের মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে। ভূমিকম্পের উৎসস্থলের দূরত্ব, গভীরতা ও কম্পনের মাত্রার চেয়েও এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে এলাকাটি। অঞ্চলটি ‘মধুপুর চ্যুতি’ বা মধুপুর ফল্টের অংশ। ‘ফল্ট’ মানে হলো ভূতাত্ত্বিক চিড় বা খাদ।

আমরা জানি, আমাদের ভূত্বক সাতটি বড় ও আটটি ক্ষুদ্র টেকটোনিক প্লেট বা কমবেশি ১০০ কিলোমিটার পুরু আস্তরণখণ্ডের ওপর টিকে রয়েছে। দুই প্লেটের সীমান্ত এলাকায় পার্বত্যাঞ্চল দেখা যায় এবং প্লেটে প্লেটে নড়াচড়া ও ঘষাঘষির কারণে সেখানে ভূমিকম্পের উৎস ও ঘনত্ব বেশি। এর বাইরেও প্লেটের ভেতরে কিছু চিড় ধরা অঞ্চল আছে। সেখানেও ভূমিকম্পের উৎস থাকতে পারে। বাংলাদেশে যেমন রয়েছে ডাউকি চ্যুতি বা মধুপুর চ্যুতি।

মধুপুর চ্যুতি কতটা সক্রিয় ও ঢাকার জন্য ভূমিকম্প ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিভিন্ন মত ছিল। কারণ চ্যুতি সাধারণত পাহাড়ি অঞ্চলে থাকে। মধুপুর চ্যুতি শুধু নদীঘেরা পলিবাহিত অঞ্চলেই অবস্থিত নয়; ১৮৮৫ সালের পর সেখান থেকে কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়নি। প্রায় দেড় শতাব্দী পর চ্যুতিটি তার অস্তিত্ব জানান দিল। শুধু শুক্রবার ভোরে নয়; গত ২৫ এপ্রিলও ৩ দশমিক ৯ মাত্রায় ভূমিকম্পটির উৎস ছিল ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের তারাব এলাকা। তার মানে, পদ্মা, যমুনা, ধলেশ্বরীর নিচে চাপা পড়া ভূগর্ভস্থ দৈত্যটি আবার জেগে উঠছে?

মধুপুর চ্যুতির ঘুমন্ত দৈত্য জেগে উঠলে কী ঘটতে পারে? মূল ভয় আসলে ঢাকা নগরকে নিয়ে। এমনিতেই সমতল ভূমির বহুলাংশ বাংলাদেশে পার্বত্যাঞ্চলের মতো ভূতল ওলটপালট হয়ে যায় না। কমবেশি এক শতাব্দী আগে একাধিক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে সেটা দেখা গেছে। কিন্তু মুশকিল হলো, গত এক শতাব্দীতে দেশের প্রায় সর্বত্র যেমন পাকা দালানকোঠা বেড়েছে, তেমনি ঢাকা পরিণত হয়েছে কংক্রিটের জঙ্গলে। আর মধুপুর চ্যুতির ঘুমন্ত দৈত্য জেগে উঠলে সবার আগে এবং সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে ঢাকা নগরীই। ২০১৮ থেকে ২০২২ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মধুপুর চ্যুতিতে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে। যে কোনো বিবেচনাতেই এটা ভয়াবহ।

এক রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে জীবন্ত মানুষ বা লাশ উদ্ধার করতেই যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল, সেখানে ভূমিকম্পে সাড়ে আট লাখ ভবন বিধ্বস্ত হলে কী ঘটবে– ভাবা যায়! বিষয়টি কেবল ভবনের সংখ্যাগত নয়। যেভাবে গায়ে গা ঘেঁষে ভবন তৈরি হচ্ছে, সড়ক সংকুচিত হচ্ছে, মাঠ ও উদ্যান হারিয়ে যাচ্ছে; এই শহরে কে কোথায় গিয়ে কাকে উদ্ধার করবে? এত জনবল, প্রযুক্তি, উপকরণই বা কোথায়? ওদিকে প্রস্তুতিও তথৈবচ।

২০১৩ সালে রানা প্লাজায় ধস এবং ২০১৫ সালে নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশে ভূমিকম্প প্রস্তুতি নিয়ে বেশ তোড়জোড় দেখা দিয়েছিল। এ ব্যাপারে সক্রিয় ও ধারবাহিক ভূমিকা রেখে চলেছিলেন (প্রয়াত) অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। কিন্তু ২০২০ সালে এই প্রকৌশল বিশেষজ্ঞের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভূমিকম্প সোসাইটিও অলস অকেজো পড়ে রয়েছে বলে সমকাল খবর দিচ্ছে।

ভূমিকম্প প্রস্তুতি নিয়ে ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে– ‘জোড়াতালি দিয়ে চলছে ঘূর্ণিঝড় গবেষণা কেন্দ্র। যন্ত্রপাতি থাকলেও ব্যবহার না করায় অকেজো হয়ে পড়ছে। দুর্যোগে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য জরুরি পরিচালন কেন্দ্র তৈরি হলেও জনবল নিয়োগ হয়নি। ঢাকায় ৬ লাখ ভবনের ৬৬ শতাংশই নিয়ম মেনে হয়নি, নতুন ভবনগুলোতেও উপেক্ষিত নীতিমালা। দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বিল্ডিং কোড। (সমকাল, ৪ মার্চ, ২০২৩)।

এই পরিস্থিতিতে করণীয় কী? সহজ ও সরল উত্তর– প্রস্তুতি নিতে হবে। ভূমিকম্প হচ্ছে জীবনানন্দের ভাষায়, পৃথিবীর গভীরতর অসুখ। প্রস্তুতি ছাড়া এর কোনো প্রতিষেধক নেই। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ বলেন, ভূমিম্প হচ্ছে পৃথিবীর মৃগী রোগবিশেষ। কখন কোথায় দেখা দেবে, আগাম বলা প্রায় অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে সর্বাত্মক প্রস্তুতির বিকল্প নেই। এই ভয়ের ক্ষেত্রে প্রস্তুতিই হচ্ছে একমাত্র অভয়।

ভূমিকম্প প্রস্তুতি মানে কেবল প্রকল্প প্রণয়ন, যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ক্রয় নয়। পরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড মেনে চলা; যত্রতত্র ভারী অবকাঠামো, কংক্রিটের জঙ্গল তৈরি না করাও প্রস্তুতির অংশ। খোলা জায়গা, মাঠ, সড়ক, উদ্যানও রক্ষা করতে হবে। শুক্রবারের বিশেষ ভূমিকম্পটি সেই তাগিদই দিয়ে গেল।

শেখ রোকন: সহযোগী সম্পাদক, সমকাল
skrokon@gmail.com