বিজেপি শাসিত মণিপুরজুড়ে মেইতি ও আদিবাসীদের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। দাঙ্গা দমনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তাদের মতে, পরিস্থিতি এখন ‘তাঁদের নিয়ন্ত্রণে’ থাকলেও, তা এতটাই চরমে উঠেছিল যে রাজ্যটির সরকার শুক্রবার দেখামাত্র গুলির নির্দেশ জারি করেছিল। সহিংসতা রাজধানী ইম্ফল থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের উপত্যকা শহর চুরাচাঁদপুরে বুধবার শুরু হলেও রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়তে দেরি করেনি। ব্যাপকভাবে বিবেচনা করলে এ সহিংসতার পেছনে দুটি কারণ পাওয়া যায়।

প্রথমত, মেইতি সম্প্রদায়ভুক্ত মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং-এর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার গত কয়েক বছরে আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড়ে পপিক্ষেতের বিশাল অংশ ধ্বংস করেছে এবং মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে সংরক্ষিত বন থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসীদের উচ্ছেদ করেছে। এটি আদিবাসীদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে কুকিদের অভিযোগ– তাঁদের কয়েকটি গির্জা ও অনেক বাড়ি নিয়ম মেনে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও ওই অভিযানে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, মেইতিরা– যাঁরা হিন্দু এবং ঐতিহাসিকভাবে সংবিধানের ‘সাধারণ’ বিভাগের আওতাভুক্ত– ইদানীং তপশিলি আদিবাসী (এসটি) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে চাইছেন। এটি আদিবাসীদের আতঙ্কিত করেছে, কারণ ‘সাধারণ’ থেকে এসটি হয়ে উঠলে মেইতিরা চাকরি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে এসটিদের জন্য সংরক্ষিত সরকারি সুবিধায় ভাগ বসাবেন।

বেশিরভাগ মেইতি ইম্ফল উপত্যকা এবং আশপাশের অঞ্চলে বাস করেন। তবে রাজ্যের ১৬টি জেলার পাহাড়ি এলাকায়ও কিছু মেইতি বাস করেন। অন্যদিকে আদিবাসী– যাঁরা কুকি, নাগা এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও ধর্মে খ্রিষ্টান– মণিপুরের প্রায় সব পার্বত্য অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এটাও মাথায় রাখতে হবে, কয়েক দশক ধরে মণিপুরের সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মেইতি প্রাধান্য চলছে। অনেক আদিবাসী বিধায়কও অবশ্য সবসময় সরকারে অংশ নিয়েছেন এবং সরকার গঠনে ভূমিকা পালন করেছেন। কংগ্রেস দলভুক্ত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী রিশাং কিশিং একজন তাংখুল নাগা ছিলেন, মেইতি নন।

মেইতিদের মধ্যে যাঁরা এসটি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ হতে চান, তাঁরা দুটি যুক্তি তুলে ধরেছেন। প্রথমত, তাঁদের মতে– অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো আর্থিকভাবে দুর্বল অনেক মেইতি আছেন, যাঁরা ‘সাধারণ’ বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় অসুবিধায় পড়েন। দ্বিতীয়ত, আঠারো শতকের গোড়ার দিকে হিন্দু ধর্ম– বিশেষ করে বৈষ্ণব ধর্ম– গ্রহণের আগে তাঁরাও আদিবাসী ছিলেন। তাঁদের সমন্বয়বাদী সংস্কৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, তাঁরা শুধু প্রকৃতিবাদী ধর্ম ‘সনমাহিজম’ ছেড়ে একটি প্রধান ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এতে তাঁদের আদিবাসী সত্তা বদলে যায় না।

আদিবাসীরা মনে করেন, মেইতিদের এসব যুক্তি এসটির জন্য বরাদ্দ সরকারি সুবিধাগুলো হস্তগত করার অজুহাত মাত্র। তাঁদের বক্তব্য, মেইতিরা দীর্ঘদিন ধরে মণিপুরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করেছেন; এখন পিছিয়ে থাকা আদিবাসীদের প্রাপ্য সম্পদেও ভাগ বসাতে চান। এ জন্য যদি ‘সাধারণ’ বিভাগ থেকে খারিজ হতে হয় এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ঝুঁকিতে পড়ে, তাতেও মেইতিদের ক্ষতি নেই।

পার্বত্য এলাকায় পপি বাগান ধ্বংসের বিষয়টি আরও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। মণিপুরে বিজেপির প্রথম মেয়াদ শুরু হয় ২০১৭ সালে। তখন থেকে মণিপুর সরকার পাহাড়ে হাজার হাজার একর পপি বাগান ধ্বংস করে চলছে। উল্লেখ্য, পূর্ব মণিপুরের পাঁচটি জেলা মিয়ানমারের লাগোয়া। এ সীমান্তের দৈর্ঘ্য অন্তত ৪০০ কিলোমিটার। কিন্তু এ সীমান্তের মাত্র ১০ শতাংশে তারকাঁটার বেড়া আছে। অর্থাৎ অঞ্চলটি মাদক চোরাচালানের জন্য উন্মুক্ত। ফলে মণিপুরের ছয়টি পার্বত্য জেলা– উখরুল, সেনাপতি, কাংপোকপি, কামজং, টেংনুপাল ও চুরাচাঁদপুরে পপি চাষ একটি প্রধান সমস্যা। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এ গাছের চাষ সংশ্লিষ্ট অধিবাসীদের আয়ের একটি সহজ উৎস নিশ্চিত করে। কারণ, এটি মরফিনসহ বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

জমি ও জীবিকা নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই ইম্ফল উপত্যকায় কয়েকটি গির্জা ভেঙে ফেলার কারণে বিষয়টি একটি সাম্প্রদায়িক রং নেয়। তাই অনেকের পক্ষে চলমান সহিংসতাকে হিন্দু মেইতি বনাম খ্রিষ্টান আদিবাসী সংঘাতরূপে বর্ণনা করা সহজ হয়। এই বারুদের স্তূপে আগুন জ্বলে ওঠে এপ্রিল মাসে, যখন মণিপুর হাইকোর্ট বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারকে মেইতিদের এসটি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা যায় কিনা, তা পরীক্ষা করার জন্য কেন্দ্রের কাছে একটি অনুরোধ পাঠাতে বলেন।

কুকি, নাগাসহ বিভিন্ন আদিবাসী– যাঁরা অতীতে একে অন্যের বিরুদ্ধে বহু রক্তক্ষয়ী লড়াই করেছেন– তখন তাঁদের একই ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হন এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একটি ‘ঐক্যবদ্ধ আদিবাসী প্রতিবাদ’ গড়ে তোলেন।

এটা ঠিক, বর্তমান সহিংসতায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারীরা কুকি ও মেইতিদের একটি অংশ মাত্র। তবে এটাও মানতে হবে, তাঁদের কর্ম পুরো সম্প্রদায়কে এ সংঘাতে টেনে এনেছে। আবার নাগাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাঁরা রাস্তার বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন না। ওদিকে মেইতিদেরও একটি অংশ এসটি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ হতে চাইলেও বেশিরভাগই ‘সাধারণ’ বিভাগে থেকে তাঁদের সমন্বিত পরিচয়– সনমাহিজম ও হিন্দুত্বের মিশ্রণ– ধরে রাখতে চান।

মোদ্দাকথা, দৃশ্যত জাতিগত বিদ্বেষপ্রসূত উত্তেজনা বলে মনে হলেও চলমান সহিংসতার আসল কারণ হলো, সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎপ্রত্যাশী সম্প্রদায়গুলোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ ও সুবিধার অপ্রতুলতা।

দেবানিশ আচম: এনডিটিভির বার্তা বিভাগের সম্পাদক; এনডিটিভি থেকে ভাষান্তরিত