
দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট, অথচ গ্রীষ্মের তাপদাহে চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট কম। ২০২২ সালের ১ নভেম্বর বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সংসদকে জানিয়েছিলেন, ‘২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার (২৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৯৭৩ কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়েছে।’ পুরোটাই হয়েছে এই সরকারের আমলে। প্রশ্ন হচ্ছে, ২৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেও কেন মানুষকে দুঃসহ লোডশেডিং থেকে বাঁচানো গেল না? কেন সক্ষমতার চাইতে প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে? গত এপ্রিল মাসেও যখন সর্বোচ্চ ১৪-১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে, তখনও ঘাটতি থেকেছে ১-২ হাজার মেগাওয়াট।
প্রশ্ন হচ্ছে, সক্ষমতার ধারেকাছেও উৎপাদন করা যাচ্ছে না কেন? যেমন গত ১২ এপ্রিল জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ২৩ হাজার ৩৩২ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ১৫৪ মেগাওয়াট, অর্থাৎ সক্ষমতার তুলনায় ৮ হাজার ১৭৮ মেগাওয়াট কম। তারপরও সেদিন ৭৭৬ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। কারণ সেদিন ১৫৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র সক্রিয় ছিল, যার মধ্যে ৪৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের (৩১.৪%) ইঞ্জিন-যন্ত্রপাতির সমস্যা ছিল, ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র (২২.২%) জ্বালানি সংকটে ভুগেছে এবং ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে (৭.৮%) মেরামতের কাজ চলছিল। অর্থাৎ ৯৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র (৬১.৪%) ঠিকমতো চলেনি, মাত্র ৩৫ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র ঠিকঠাক চলেছে।
ওদিকে তেল আমদানির বকেয়া জমেছে ৪ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। এ অবস্থায় বিপিসিকে তেল সরবরাহ না করার কথা জানিয়েছে সাত বিদেশি প্রতিষ্ঠান। মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ডলার সংকটের কারণে এলসির বকেয়া পরিশোধ করা যাচ্ছে না। জ্বালানি তেল সরবরাহ বাবদ বিপিসির কাছে পাওনাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ভিটল এশিয়া, চীনা প্রতিষ্ঠান ইউনিপেক, সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (ইএনওসি), ভারতীয় আইওসিএল, ভারতীয় নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল), সিঙ্গাপুরের পেট্রো চায়না ও ইন্দোনেশিয়ার বুমি সিয়াক পুসাকো (বিএসপি) উল্লেখযোগ্য। সর্বশেষ ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (আইওসিএল) পাওনা আদায়ে ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।
ঝুঁকিতে আছে অভ্যন্তরীণ খাতও। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে ৬০ শতাংশের বেশি গ্যাস সরবরাহ করা শেভরনের বকেয়া প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা (সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। ছয় মাসের বেশি বকেয়া থাকায় চুক্তি অনুসারে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে এই মার্কিন কোম্পানি।
ডলার সংকট ছাড়াও লোডশেডিংয়ের অন্যান্য কাঠামোগত কারণ আছে। যেমন– চাহিদা অনুযায়ী সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো না থাকা। গ্রীষ্মে যখন চাহিদা বাড়ে, তখন সারাদেশে পল্লী বিদ্যুৎসহ বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রায় ৭০ হাজার ট্রান্সফরমার ঝুঁকিতে পড়ে। লোডশেডিং না করা হলে ট্রান্সফরমার পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। অর্থাৎ চাহিদার সঙ্গে বিতরণ ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ হয়নি। হয়েছে অন্য জায়গায়।
চলমান বিদ্যুৎ সংকটের পেছনের কারণগুলোকে মোটামুটি পাঁচ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক. প্রাথমিক জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা সরবরাহ অনিশ্চয়তা, আমদানিনির্ভর জ্বালানি নীতি; দুই. ডলার সংকট এবং উচ্চ ক্যাপাসিটি চার্জ; তিন. সবুজ বিদ্যুতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগহীনতা; চার. উৎপাদন সঞ্চালন ও বিতরণে সমন্বয়হীনতা; পাঁচ. অক্ষম ও ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও নিম্নমানের যন্ত্রপাতি। এ ছাড়া দেশের স্থল ও সমুদ্র উপকূলে নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণের চেষ্টাও নগণ্য।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে প্রাথমিক জ্বালানি– তা তেল হোক, গ্যাস হোক বা হোক কয়লা, তার একটানা সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়নি। পাশাপাশি স্থায়ী চুক্তিভিত্তিক আমদানি ও অভ্যন্তরীণ জ্বালানি উৎসের বিষয়গুলো যথাযথভাবে বিবেচনায় না নিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রগুলো প্রয়োজনের সময় সচল রাখা যাচ্ছে না। উৎপাদন না করেও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিপুল অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ শোধ করতে হচ্ছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকারের কাছে বিক্রিতে যে মুনাফা হয়, বসে বসে ক্যাপাসিটি চার্জ খেলে লাভ আরও বেশি।
দেড় বছরে পিডিবির গড় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৮১ শতাংশ। রেন্টাল, আইপিপি ও সরকারি বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল সেপ্টেম্বর ’২২ থেকে জানুয়ারি ’২৩ পর্যন্ত বকেয়া পড়েছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছর থেকে আদানির অন্যায্য ক্যাপাসিটি চার্জ এবং রূপপুরের রাশিয়ান ঋণের কিস্তি শুরু হলে পিডিবির দেনার দায় সীমাহীন হবে।
এদিকে বিশেষ গোষ্ঠীর কমিশন বাণিজ্যের লোভে দীর্ঘমেয়াদি আমদানি চুক্তি না করে মোট তেল ও গ্যাস আমদানির প্রায় ৫০ শতাংশই খোলাবাজার থেকে করা হচ্ছিল। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পরে বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাসের দাম বাড়লে সংকটে পড়ে সরকার। বর্তমানে বিশ্ববাজারের দাম কমে এলেও বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে সরকার পর্যাপ্ত জ্বালানি কিনতে পারছে না, নতুন সমস্যা আমদানি এবং উৎপাদনে বকেয়া পরিশোধে অনিয়ম।
লোডশেডিংয়ে অন্য কারণ আঞ্চলিক গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনের রক্ষণাবেক্ষণ, কয়লা সংকটে বড়পুকুরিয়া ও রামপাল বন্ধ থাকা ইত্যাদি। জীবাশ্ম জ্বালানি পাওয়া যেখানে দিন দিন কঠিন হচ্ছে, সেখানে সবুজ জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতে ব্যাপক বিনিয়োগ করা দরকার ছিল। এটা না করা পরিকল্পনাগত অদূরদর্শিতা। মাত্র ৪ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য, বাকি ৯৬ শতাংশের জন্য দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে ডলারে তেল-গ্যাস-কয়লা কিনতে হচ্ছে। প্রায় সব নতুন ও আমদানিমুখী বিদ্যুৎকেন্দ্রই কয়লাভিত্তিক। ফলে আমাদের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত মূলত অটেকসই থেকে গেছে। বর্তমান লোডশেডিংয়ের প্রধানতম কারণ তাপীয় অদক্ষ, নিম্ন প্লান্ট ফ্যাক্টর (টানা সচল থাকার সক্ষমতা) এবং ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঘন ঘন রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়া।
গত ১৮ এপ্রিল লোডশেডিংয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ভোগের জন্য বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে তাপদাহের কারণ দেখিয়েছেন। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে আবহাওয়া পূর্বাভাসের সংযোগ ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে, তীব্র গরম কিছুটা কমে সহনীয় হয়ে এলেই কি লোডশেডিং চলে যাবে? উত্তরটা হ্যাঁ বলার অবকাশ নেই। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য লোডশেডিং কেন হচ্ছে এবং কবে থামবে, সেই ব্যাখ্যা দেয় না। শুধু তাপদাহকে দোষারোপ না করে বিদ্যুৎ সংকট ও লোডশেডিংয়ের কাঠামোগত, কারিগরি ও ব্যবস্থাপনাগত অদূরদর্শিতাকে চিহ্নিত করা হোক!
অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে লোডশেডিং সরাসরি সম্পর্কিত। বিদ্যুৎ খাতের অপচুক্তি, ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি, ভুল জ্বালানিনীতি, উৎপাদন-সঞ্চালন-বিতরণের অসমন্বিত পরিকল্পনা শুধরানো না হলে, নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ পরিকল্পনায় না গেলে বিদ্যুৎ সংকট দীর্ঘমেয়াদে চলতে পারে। অর্থাৎ আমরা ফিরে যাচ্ছি এক যুগ আগের অবস্থায়– যখন বলা হতো লোডশেডিং স্বাভাবিক, এর সঙ্গে মানিয়ে নিন। কিন্তু মাঝখান থেকে খরচ হয়ে গেল ২৮ বিলিয়ন ডলার এবং তার কিস্তি ও সুদ টানার দায়! অর্থনীতি চলবে কীভাবে, মানুষ বাঁচবে কীভাবে?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক
faiz.taiyeb@gmail.com
মন্তব্য করুন