- মতামত
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনে উদ্যোগ নেওয়া হলে সহায়তা করব
সাক্ষাৎকার: ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনে উদ্যোগ নেওয়া হলে সহায়তা করব

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য ছিলেন। তিনি ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক এবং ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতকোত্তর এই আমলা নিউজিল্যান্ড থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
সমকাল: দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
কামাল উদ্দিন আহমেদ: আমাদের দেশটি গত ৫২ বছরে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা, কষ্ট পার হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এ সময়ে আর্থিক দিক দিয়ে অবস্থা অনেক ভালো হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মানুষ জড়িত হচ্ছে– অন্তত আগের মতো পুরোনো কাপড় পরে চলতে হয় না; যাতায়াতের কষ্টও তেমন নেই। একটা সমাজে যখন আইনের শাসন থাকে, তখনই এ ধরনের উন্নতি ঘটে। কিন্তু কোনো সমাজই একেবারে নিখুঁত নয়। নিউজিল্যান্ড বা ডেনমার্কের মতো কিছু দেশও যে সার্বিক দিক থেকে অনেক উন্নত অবস্থানে, সেখানেও আইন-শৃঙ্খলাজনিত কিছু সমস্যা আছে। এটা ঠিক, কিছু দেশ আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, কিন্তু সেসব দেশেরই কোনো কোনো অংশে আমাদের উন্নয়নের প্রশংসা করা হচ্ছে। সবকিছু মাথায় রেখে বলা যেতে পারে, আমাদের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো ছাড়া খারাপ বলার অবকাশ নেই।
সমকাল: নিরাপত্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমিতি করার অধিকারসহ সংবিধানস্বীকৃত নাগরিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা দেশে কতটুকু?
কামাল উদ্দিন আহমেদ: আমাদের এত উন্নয়নের মাঝেও বঞ্চনার হাহাকার আছে– এটি সোজা কথা। কিন্তু সে হাহাকার কতটুকু, সেটিই পরিমাপের বিষয়। আপনি যে বিষয়গুলোর কথা বললেন, সেগুলো যদি ভালোর দিকে না থাকত তাহলে আমাদের উন্নয়ন নজর কাড়ত না। ফলে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো– এটিই বলতে হবে। কিছু ঘটনা আছে, যেগুলোকে মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে আমরাও বলেছি। যেমন– নওগাঁয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু, তেলেগুদের উচ্ছেদ ইত্যাদি।
সমকাল: আপনি যেসব ঘটনার কথা বললেন, সেগুলো কি মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির সূচক হতে পারে না?
কামাল উদ্দিন আহমেদ: না, আমি তা বলব না। আপনি যদি ঘটনাগুলোকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করেন, দেখবেন– একটি প্রতিষ্ঠানের দু-একজন লোকের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের ফলস্বরূপ তা ঘটেছে। এ ধরনের প্রবণতা কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সার্বিক আচরণে দেখা যায় না। নওগাঁর ঘটনাটি খেয়াল করুন; প্রশাসনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের শিকার হওয়ায় সংক্ষুব্ধ হন। তাঁর এ সমস্যা সুরাহার একটি আইনি পথ আছে। কিন্তু তিনি সে পথে না গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যকে বিষয়টি জানালেন। সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও যথাযথ পথ অনুসরণ না করে দ্রুত অ্যাকশনে চলে যান। এ ক্ষেত্রে র্যাপিড অ্যাকশনের কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি কিন্তু অস্ত্র বা মাদক নিয়ে পালাচ্ছিলেন না; এলাকতেই ছিলেন। এখানে স্পষ্ট, সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর দায়িত্বহীন আচরণের ফলেই নওগাঁর দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটেছে। এখানে প্রতিষ্ঠান দায়ী নয়।
সমকাল: দেশের ভেতরেই অনেক বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন এখানকার মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
কামাল উদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশে অনেক এনজিও আছে, যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে। সম্প্রতি এ রকম একটি সংস্থার সঙ্গে কথা হয়েছে আমার, যারা সংগঠনের প্যাডে নিজের নামটাও শুদ্ধ করে লিখতে পারেনি। তারা নাকি সালিশ করে অথচ আইনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের এ অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ওই সংস্থাকে ধরা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সালিশের নামে এরা উভয় পক্ষের কাছ থেকে সালিশের খরচ হিসেবে টাকা আদায় করে।
সমকাল: এগুলো তো ভুইফোঁড় কিছু সংগঠন; দেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংগঠন আছে।
কামাল উদ্দিন আহমেদ: হ্যাঁ, বেশ কয়েকটি বড় সংস্থা আছে, যাদের কাজের অবস্থা ভালো। তবে তাদের সমস্যা হলো, নিছক পত্রিকার কাটিংয়ের ভিত্তিতে এরা ঘটনাগুলোকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে পাঠিয়ে দেয়। নিজেরা খুব কমই সরেজমিন তদন্ত করে। আবার হয়তো ৫০টি ঘটনা পাঠিয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ৩০টি ঘটনায় মানবাধিকার কমিশন ব্যবস্থা নিয়েছে। তারপরও ওরা বলতে থাকে– মানবাধিকার কমিশন কোনো কাজ করে না, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খুব খারাপ। সরেজমিন তদন্ত ছাড়া এভাবে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করা ঠিক না।
সমকাল: আপনারা কি সরেজমিন তদন্ত করেন?
কামাল উদ্দিন আহমেদ: নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা ঘটনাস্থলে যাই। বান্দরবানের ম্রো পাড়ায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় আমি নিজে অকুস্থলে গিয়েছি। আমাদের অভিযোগ বিভাগের একজন জেলা জজকে ওখানে প্রথমে পাঠিয়েছি; আবার ওই এলাকার অধিবাসী কমিশনের একজন সদস্যও সেখানে গেছেন। বেসরকারি কোনো মানবাধিকার সংস্থা গেলেও মানুষের মাঝে একটা নাড়াচাড়া পড়ে। পত্রপত্রিকায় খবর হয়। অপরাধীরা ভয় পায়। জনমানুষের শক্তিও কিন্তু একটি বিরাট শক্তি; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ভয় পান এটি ভেবে যে– গাফিলতি করলে ওরা আমাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে পারে। আমাদের প্রত্যেককে জায়গামতো কাজ করতে হবে। শুধু মুখের কথায় পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না; উন্নতিও হবে না।
সমকাল: জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ ক্ষেত্রে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করছে না কেন?
কামাল উদ্দিন আহমেদ: অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা এখন একটি বাস্তব সমাধানের দিকে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে ৬৪ জেলায় কমিটি গঠন করেছি। ৩২ সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটিতে স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি আছেন। তাঁরা নিয়মিত সভা করছেন এবং সভার প্রতিবেদন আমাদের পাঠাচ্ছেন। আমরাও বিভিন্ন জেলায় গিয়ে কমিটিগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছি। আমরা এভাবে স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করার চেষ্টা করছি। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থাও নিচ্ছি।
সমকাল: দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সরকারের দিক থেকে অসহযোগিতার সম্মুখীন হয়েছেন?
কামাল উদ্দিন আহমেদ: দেখুন, আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠান নই। আমরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র আমাদের যে দায়িত্ব দিয়েছে, তা পালনে এ পর্যন্ত সরকারি কোনো সংস্থার কাছ থেকে অসহযোগিতা পাইনি। আমরা ন্যায়ানুগতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট। আমরা একটি ঘটনায় পুলিশকেও জরিমানা করেছি এবং তা মান্যতা পেয়েছে।
সমকাল: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃক তেলেগুদের উচ্ছেদের বিষয়টি নিয়ে আপনারা কী করছেন?
কামাল উদ্দিন আহমেদ: তেলেগুদের বিষয়টি আমরা আমাদের একটি বেঞ্চে উত্থাপনের পর সিটি করপোরেশনকে নোটিশ দিয়েছি। করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী ইতোমধ্যে এর জবাবও দিয়েছেন। সেখানে তাঁরা লিখেছেন আপাতত তেলেগুদের একটা জায়গায় থাকতে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে যাঁরা করপোরেশনের কর্মচারী, তাঁদের ইতোমধ্যে ঘর করে দেওয়া হয়েছে। অন্যরা করপোরেশনের লোক না হলেও মানবিক কারণে তাঁদেরও স্থায়ী পুনর্বাসন করা হবে উচ্ছেদের পর খালি হওয়া জায়গায় নির্মিত বিল্ডিংয়ে। আমার বিশ্বাস, সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত এ মানুষগুলোর স্থায়ী পুনর্বাসন হবে। আমরা লেগে আছি, এখানে অন্যথা হওয়ার সুযোগ নেই।
সমকাল: সরকার একটি বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়ন করছে, সেখানে আপনাদের কোনো ভূমিকা আছে?
কামাল উদ্দিন আহমেদ: আমরা এ বিষয়েও তৎপর আছি। এ নিয়ে বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গেও আমাদের সমন্বয় আছে।
সমকাল: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে নাগরিক সমাজের উদ্বেগ সম্পর্কে কী বলবেন? আইনটি নওগাঁর ঘটনায় আবারও আলোচনায়।
কামাল উদ্দিন আহমেদ: দেখুন প্রতিটি ক্ষেত্রেই দায়িত্বশীলতার বিষয় আছে। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের অনেক এগিয়ে দিয়েছে। এটিকে আপনি অপব্যবহার করতে পারেন না। আপনার হাতে একটি ছুরি আছে। এটি দিয়ে আপনি আম কাটবেন না কাউকে আঘাত করবেন, তা আপনার দায়িত্বশীলতার বিষয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি কিন্তু প্রয়োজনীয়; দরকার এর অপব্যবহার বন্ধ করা। বিষয়টি সরকারেরর মন্ত্রীরাও স্বীকার করছেন। কিছুদিন আগেও আইনমন্ত্রী বলেছেন, আইনটি সংশাধন করবেন তাঁরা।
সমকাল: আপনাদের দিক থেকে কি এ নিয়ে কোনো সুপারিশ আছে?
কামাল উদ্দিন আহমেদ: আমরা মনে করি, আইনটি সংশোধনের দরকার আছে। এ বিষয়ে সরকার উদ্যোগ নিলে আমরা সহায়তা করব। এ সংশোধনী নিয়ে কিছু কাজ করার ইচ্ছা আমাদের আছে।
সমকাল: আপনাকে ধন্যবাদ
কামাল উদ্দিন আহমেদ: আপনাকে এবং সমকালের পাঠকদেরও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করুন