
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমাদের জাতীয় জীবনের সমস্ত সমস্যাই আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে উদ্ভূত।’ বাংলাদেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীই যখন অন্তঃসারশূন্য, তখন অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের এ রকম বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য আমাদের ভীষণ আনন্দ দেয়। অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের এ বক্তব্য গভীরভাবে বিশ্লেষণ, উপলব্ধি ও অনুসরণ একান্ত জরুরি।
বাঙালি নয়; বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমরা যারা বসবাস করি, আমাদের আত্মপরিয়টা কী? বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের শুধু চিন্তায় নয়, বুদ্ধিতে ধরা পড়ে দৈন্য। দেশের সব নাগরিককে জাতীয়তা ‘বাঙালি’ লিখতে বাধ্য করা হলো। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীভুক্ত নাগরিকদের জাতীয়তা যে বাঙালি নয়– তা আমাদের উপলব্ধিতে আসেনি। তাদের ‘বাঙালি’ লিখতে বাধ্য করা যে অন্যায়, তাও আমরা বুঝিনি। একটি দেশের মধ্যে একাধিক জাতির মানুষ থাকবে এবং পরিচয়পত্রে যার যার জাতীয়তা সে উল্লেখ করবে এবং সবার নাগরিক পরিচয় হবে বাংলাদেশি। এই সামান্য জ্ঞানের পরিচয় আমরা দিতে পারিনি। বস্তুত, জাতিরাষ্ট্রের ধারণাই আধুনিক অভিবাসনের যুগে এখন অচল।
তার মানে হলো, আমাদের আত্মপরিচয়ের সংকট স্বাধীনতার পরপরই দেখা দেয়, যা এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আমি যদি খ্রিষ্টধর্মের লোক হই, তাহলে আমি খ্রিষ্টান, না বাঙালি? অর্থাৎ ধর্মীয় পরিচয় আমার বহিরাঙ্গে দরকার আছে কিনা? আমি কি বাঙালি খ্রিষ্টান, না খ্রিষ্টান বাঙালি? কোন পরিচয়টা আমার প্রথম। বাঙালি হিসেবে কী কী বৈশিষ্ট্য আমার থাকা উচিত, আর খ্রিষ্টান হিসেবে আমার কী কী আচার পালন করা উচিত? আমি কী পোশাক পরিধান করব, আমার খাদ্যাভ্যাস কী হবে? কীভাবে আমি সম্ভাষণ বা অভিবাদন করব? কোন ভাষায় নাম রাখব? এ বিষয়গুলো আমরা আজও ঠিক করতে পারিনি; ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারিনি।
লেবাননসহ আরব বিশ্বের অনেক দেশের নাগরিকই আরবীয় পরিচয় ধর্মীয় পরিচয়ের আগে নিয়ে আসেন, যা নামের মধ্যে প্রতিফলিত। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের কেবিনেটে উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন তারিক আজিজ, যিনি ছিলেন খ্রিষ্টান। কিন্তু নাম রেখেছেন আরবি ভাষায়। রাশিয়াতে আমার ছাত্রী, দানিয়া তাজেদিনোভা তাতার বংশোদ্ভূত মুসলিম। রাশিয়াতে বোঝাই যাবে না– কে কোন ধর্মের? কারণ সবার নামই রুশ জাতীয়তা প্রকাশক রুশ ভাষায়। মাতৃভাষায় নাম থাকলে বোঝাই যাবে না– কে কোন ধর্মের। আর যদি তা হয়, সাম্প্রদায়িকতা কমে যাবে এবং রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সব নাগরিকের সমান সুযোগ তৈরি হবে।
আমরা যদি উন্নয়নের ইতিহাস অধ্যয়ন করি, দেখতে পাব, যেসব দেশ ধর্মের ওপরে সংস্কৃতিকে স্থান দিয়েছে, তারাই উন্নতির পরাকাষ্ঠায় পৌঁছতে পেরেছে। কারণ জাতি-ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত মানবীয় গুণের সমষ্টিই সংস্কৃতি। সংস্কৃতির মূল উপাদান হলো শ্রেয়বোধ, কল্যাণচেতনা, স্বাধিকারবোধ, সমন্বিত জীবনচেতনা ইত্যাদি। সংস্কৃতির ছায়ায় যেভাবে মানুষের ঐক্য সম্ভব; ধর্মের ছায়ায় সে ঐক্য সম্ভব নয়। কারণ একেক জন মানুষের ধর্ম অন্যজনের চেয়ে আলাদা হতে পারে। আবার নিজের ধর্মকে অন্যের ধর্মের চেয়ে শ্রেয় মনে করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে প্রকট। সমন্বিত বা যৌথ উদ্যোগের বিশাল কর্মযজ্ঞ ছাড়া উন্নয়নের পরাকাষ্ঠায় পৌঁছানো সম্ভব নয়।
সুস্থ সংস্কৃতি সুস্থ রাজনীতির জন্ম দেয়। আবার সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশের জন্য দরকার সুস্থ রাজনীতি। ২০১৪ সাল থেকে দেশে একটি অগণতান্ত্রিক সরকার টিকে আছে এবং সংস্কৃতি ও বিনোদন জগতের একটি বড় অংশ এই অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে যাচ্ছে। যাঁরা আজকে ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ বা অপসংস্কৃতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তাঁদের অনেকেই আজকের নষ্ট রাজনীতির বিকাশে সহায়তা করছেন। তাঁরা জানেন না, নষ্ট রাজনীতির আবহে সুস্থ সংস্কৃতি বিকশিত হতে পারে না।
বাংলাদেশে সংস্কৃতি জগতের পুরোধা ব্যক্তিদের রাষ্ট্রের মালিক বনে যাওয়া লোকদের তল্পী বহনের দৃশ্য দেখে মনে পড়ে এর বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী বিংশ শতাব্দীর সাড়া জাগানো দার্শনিক ও লেখক জ্যঁ পল সার্ত্রের কথা। মার্ক্সীয় দর্শনের আলোকে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জ্যঁ পল সার্ত্রে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সক্রিয় থেকেছেন লেখায়, সংগঠনে ও আন্দোলনে। সার্ত্রে কী রকম সক্রিয় ছিলেন, সে বিষয়ে ব্রিটানিকা লিখেছে, ‘সার্ত্রে সচরাচর রাজপথে চলে যেতেন সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে দাঙ্গা করার জন্য, বামপন্থার বই বিক্রির জন্য। বিপ্লবের সহায়ক হতে পারে এমন যে কোনো কাজে লেগে যেতেন যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো জায়গায়।’ কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিশ্রুতি বা দায়বদ্ধতা একটি কথামাত্র নয়। প্রতিশ্রুতি হলো কাজ। পক্ষান্তরে আমাদের সংস্কৃতিজগতের কর্তাব্যক্তিদের দায়বদ্ধতার ছিটেফোঁটা কত কাল হলো, আমরা দেখি না!
মূল দুর্ভিক্ষটা যে আত্মপরিচয়ের সংকটে, তা তো একজন নাট্যকার, পরিচালক, নির্মাতা বা অভিনেতার বোঝার কথা নয়। বিশেষ করে যাঁরা অগণতান্ত্রিক সরকারের গণবিরোধী কাজে সহায়তা করেন এমন প্রগতিবিরোধী লোকের মুখে সংস্কৃতি বিষয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ বড় বেমানান ঠেকে। একজন বিদগ্ধ সমাজবিজ্ঞানীই বুঝতে পারেন সংস্কৃতির জগতের এমন দুর্ভিক্ষের কারণ। তিনিই বাতলে দিতে পারেন পথ, যিনি জানেন নিম্নবর্গের মানুষকেও শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে। শুধু বিনোদনজগৎ নয়; দেশের সব কর্মযজ্ঞে শামিল করতে হবে তাদের।
উন্নত দেশগুলোতে সংস্কৃতি ও রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণের জন্য রাষ্ট্রেরই প্রতিষ্ঠান থাকে। সেখানে সমাজতত্ত্ববিদ বা সমাজবিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক, অর্থনীতিবিদ প্রমুখ বিশেষজ্ঞ নিরলস ও নিরন্তর কাজ করে যান। ব্যক্তি খাতে এ রকম থিঙ্কট্যাঙ্ক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তো আছেই। ব্যক্তি খাতে এসব প্রতিষ্ঠানকে গবেষণাকর্মে প্রণোদনা দিতে অর্থ সাহায্যও করে থাকে রাষ্ট্র। সংস্কৃতি ও রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের মতোই গুরুত্বপূর্ণ কারণ। নষ্ট সংস্কৃতি ও নষ্ট রাজনীতি এক সময় জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করবেই।
সমাজ-সংস্কৃতির এমনই সংকট নিয়েই রবীন্দ্রনাথ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছিলেন :
“হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!
…
যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”
ড. এন এন তরুণ: ইউনিভার্সিটি অব বাথ ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ
nntarun@gmail.com
মন্তব্য করুন