জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে ঘাতকগোষ্ঠী। এমনই ক্রান্তিলগ্নে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করা হয় জাতির পিতার কন্যার হাতে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরছেন জানতে পেরে জিয়াউর রহমান সাপ্তাহিক ছুটির দিনে (তখন রোববার) ৩ মে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নেন– শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হবে না। কিন্তু সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে আলোর মশাল হাতে বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা।

১৯৮১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের লাখো মানুষের সঙ্গে স্কুলপড়ুয়া একজন ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল।

দেশে ফিরেই মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত লাখো মানুষের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি আপনাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ আওয়ামী লীগ সভাপতির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বিবিসি তার সংবাদভাষ্যে ’৮১ সালের ১২ জুন বলেছে– ‘তাঁর পিতার নৃশংসতম মৃত্যুর পর বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন নিঃসন্দেহে একটি বড় ব্যাপার। এই সাহস সম্ভবত তিনি অর্জন করেছেন তাঁর পিতার কাছ থেকে।’ কার্যত স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শেখ হাসিনা স্বকীয় প্রতিভাগুণে এই দেশ ও জাতির মহানায়কের আদর্শকে প্রবলভাবে পুরো জাতির মনে ফের জাগিয়ে তোলেন। যারা স্বপ্ন দেখেছিল বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আর কখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না, তাদের সব হিসাবনিকাশ দ্রুতই পাল্টে গেল। গণমানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ে নিরন্তর সংগ্রামে এক অবিস্মরণীয় গণজাগরণই ঘটালেন না; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন করে দেশের জনগণকে সুসংগঠিত করে ঐক্যের রাজনীতির শুভসূচনা করলেন শেখ হাসিনা। তাঁরই হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর মধ্য দিয়ে দেশ দায়মুক্ত, কলঙ্কমুক্ত হতে পেরেছে। বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বপ্ন দেখছে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছার। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন রূপকথার গল্প নয়; বাস্তব। এখন লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ।

স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট তৈরির কাজ চলছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা ফিরেছিলেন বলেই আজকে ভূমিহীন ও গৃহহীনরা বিনামূল্যে লাখ লাখ ঘরসহ বাড়ি পাচ্ছেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। নিজস্ব অর্থায়নে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সারাদেশে ৫৫৬টি দৃষ্টিনন্দন মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকায় মেট্রোরেল চলছে। পাতালরেলের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। আমরা বিশাল সমুদ্রসীমা জয় করেছি। ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, আমরা আকাশও জয় করেছি। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপ করা হয়েছে। কমিউনিটি হেলথ কেন্দ্রে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় ৫ কোটি মানুষ সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। আগের চেয়ে নদীভাঙন কমে এসেছে। এখন আর নদীভাঙনে মানুষকে নিঃস্ব হতে হয় না। সময়মতো হাওরে ফসলও উঠছে।

একজন উদার গণতন্ত্রী হিসেবে তিনি দলে সবাইকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে আওয়ামী লীগকে এক শক্তিশালী গণসংগঠনে পরিণত করলেন। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর স্নেহসান্নিধ্য পাইনি, তারা তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি শেখ হাসিনার স্নেহসান্নিধ্যে ধন্য হলাম। আমরা তাঁর স্নেহচ্ছায়ায় কাছে থেকে দেখলাম দুঃখী বাংলার মানুষের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা ও আস্থা এবং দেশের মাটি-মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও অঙ্গীকার। তাঁর সাহসী সংগ্রামের একজন নিবেদিত কর্মী হিসেবে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখেছি, তিনি কীভাবে একের পর এক প্রাণনাশের আঘাত, হামলা, নির্যাতনের মুখে অমিত সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্বই দিলেন না; আমাদের বুকের ভেতরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আগুনও জ্বালিয়ে দিলেন।

সাধারণের মতোই জীবনযাপনে অভ্যস্ত আমাদের মহান নেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের গৌরব। একজন পরহেজগার মুমিন মুসলমান হলেও তাঁর চিন্তা ও চেতনাজুড়েই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতি জায়গা করে নিয়েছে। সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে তিনি দ্বিধা করেন না। খোলা বইয়ের মতো তাঁর রাজনীতি ও জীবন মানুষের সামনে উন্মুক্ত করেই তিনি পথ হাঁটেন। তাঁর সারল্য শিশুর মতো। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল তাঁর হাতের কাছেই শোভা পায়। অবসরে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে তাঁকে দেখেছি। তিনি নিজে যেমন পড়াশোনায় মগ্ন থাকেন, তেমন আমাদেরও পড়াশোনার তাগিদ দেন। সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করলেও ক্ষমতার কাছে ভিড়তে দেন না। আজকে জননেত্রী শেখ হাসিনা হচ্ছেন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, পতাকা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একমাত্র রক্ষক। নিজে রাজনীতি করার পাশাপাশি তাঁর দুই সন্তানকেও সুশিক্ষিত করে তুলেছেন। ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় আজ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে তিনি উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় এরই মধ্যেই সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনা এমন একজন নেত্রী, যিনি কর্মীদের ভালোবাসেন নিজ সন্তানের মতোই। মায়ের স্নেহ-মমত্ববোধ থেকে সন্তানদের বঞ্চিত করে তা কর্মীদের নির্দ্বিধায় দেন। অসহায় বিপন্ন মানুষের কাছে ব্যাকুল চিত্তে তিনি ছুটে যান মানবিক হৃদয় নিয়ে; মায়ের ভূমিকায় পাশে দাঁড়ান। তাঁর মতো স্নেহশীল মা, কর্মিবান্ধব সভাপতি, প্রাজ্ঞ দৃঢ়চেতা দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেত্রী যেভাবে দেশ ও মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিরন্তর পথ চলছেন; দেশের স্বার্থে যেভাবে আপসহীন দৃঢ়তা দেখিয়ে এসেছেন, তা ইতিহাসে তাঁকে অমরত্ব দেবে।

বিশ্ববরেণ্য নেতারা শেখ হাসিনা সম্পর্কে বলেছেন, ‘মেধা, যোগ্যতা, সততা আর দক্ষতায় শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায়ই নয়; সমগ্র বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে পারেন।’ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটিও তিনি জনগণকে দিয়েছেন। লোভ, মোহের ঊর্ধ্বে পথচলা বিশ্ববরেণ্য নেত্রী শেখ হাসিনা যতদিন বেঁচে থাকবেন, আমাদের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেবেন; ততদিন দেশ উন্নয়নের পথেই হাঁটবে; গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিকশিত হতেই থাকবে; গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে থাকবে। দেশ হবে তাঁর স্বপ্নের দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ। আজ তাঁর এই দেশে ফেরার শুভদিনে মহান আল্লাহর কাছে তাঁর সুস্থতা, কর্মঠ ও দীর্ঘ জীবন প্রত্যাশা করি।

একেএম এনামুল হক শামীম: উপমন্ত্রী, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়