বাংলাদেশের বিদ্যমান সমাজ কাঠামোর বৈশিষ্ট্য নির্মাণ ও সংরক্ষণে বর্গাপ্রথার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃষি উৎপাদন তথা এ অঞ্চলের সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষিজমির উৎপাদন সম্পর্কিত ব্যবহারে বর্গাপ্রথা সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেছে। ফলে কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি পুরোনো বৃত্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি বলে তা বাংলাদেশের মানুষের সমাজ কাঠামোকে ভেঙেচুরে নতুন ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারেনি। বিষয়গতভাবে শাসক শ্রেণি বা গোষ্ঠীগুলোর নিচের স্তরের মধ্যে ভাঙনের বীজ বৃক্ষে পরিণত হলেও প্রকৃত ও প্রান্তিক চাষি বর্গাপ্রথার নিগড়ে বন্দি বলে এবং তাঁরা শত সাধ সত্ত্বেও সাধ্য নেই বলে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে প্রয়োজনীয় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে সমর্থ হন না, যদিও এখন পর্যন্ত কৃষিই হলো উৎপাদন তথা সম্পদ সৃষ্টি ও বৃদ্ধির প্রধান ক্ষেত্র বা ভূমি।

প্রাচীনকালের স্বনির্ভর গ্রাম সম্পর্কে যে কথা বলা হয়, তার সব সত্য নয়। গ্রামের কর্তৃত্বকারী স্বেচ্ছাচারী গোষ্ঠীপতি ছাড়া আর কেউ প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন, স্বনির্ভর ছিল বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। এ রকম কোনো ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না। স্বনির্ভর গ্রামগুলোতে নির্ভেজাল ও নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে যে কথা বলা হয়, তা কতটুকু সভ্যতা ও মানবিকতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ– সেই বিষয়ও প্রশ্নসাপেক্ষ। গোষ্ঠীতন্ত্র বিরাজমান ছিল। ক্রমান্বয়ে তা বিকশিত হয়ে পাতি-সামন্ততান্ত্রিকতায় পরিণত হয়। গ্রামীণ পরিসরে এক ধরনের স্বেচ্ছাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল, যার মূল উৎস ছিল উৎপাদিত শস্যের আত্মসাৎ। কর্তৃত্বকারী, বলপ্রয়োগকারী শক্তি কর্তৃক উৎপাদিত ফসল আত্মসাতের সেই ধারা আজও বিদ্যমান।

যাঁরা মনে করেন, গ্রামে জোতদারি অথবা ভূস্বামীতন্ত্র, পাতি-সামন্ততান্ত্রিকতার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয় অথবা সাদৃশ্যপূর্ণ নয়; তাঁরা প্রকৃতপক্ষে ভূস্বামী শ্রেণিরই বংশধর বা ওইসব গোষ্ঠীরই লোকজন অথবা তাঁদেরই প্রতিনিধিত্ব করেন। বর্তমান অমানবিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্যাবত্তার জাদু প্রদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়। কর হিসাবে শস্যের অংশ প্রদান এবং নগদ মুদ্রা প্রদান এক জিনিস নয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, উভয়ই এক। আসলে তা নয়। কারণ নগদ মুদ্রায় কর প্রদানের মাধ্যমে কৃষকের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে পূর্বতন অবস্থার বৈশিষ্ট্যের ব্যত্যয় ঘটে। ভূস্বামীর সঙ্গে জমির ফসল তথা জমির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন একমাত্র মুদ্রাই হয়ে দাঁড়ায় সম্পর্কের ভিত্তি। আর মুদ্রা যখন সম্পর্কের ভিত্তি হয়, তখন জমি ভোগদখল নিজেই নিয়ন্ত্রণ করে না, সেও নতুন একটা নিয়মের নিয়ন্ত্রণে এসে যায়, যার নাম মুনাফা। কার্ল মার্কস ‘পুঁজি’ গ্রন্থে এর বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বাংলাদেশের কৃষক এই দৈত্যের কবলে পড়েনি।

সাবেক ছাত্রনেতা

বিষয় : সাইফ শোভন

মন্তব্য করুন