বাম পন্থার নামে খুনখারাবির পন্থা অবলম্বনকারী দলের সদস্যদের নির্মমতার শিকার হয়ে দেশে অর্ধ শতকেরও বেশি সময়ে অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে। ওই চরমপন্থিদের নির্যাতনে মৃত্যু হয়নি, কিন্তু এখনও দুঃসহ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে– এমন মানুষও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এক অনুজপ্রতিমের কাছে শুনেছি, তার বাবা কুষ্টিয়াতে চালের ব্যবসা করতেন। তখন এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে হত্যা করে চরমপন্থিরা। তার বাবা এ দৃশ্য দেখে ফেলায় তাঁকে মারধর করা হয়। সেই নৃশংসতায় স্মৃতি হারিয়ে এখনও বেঁচে আছেন তিনি। তিন কন্যা নিয়ে মাকে জীবনযুদ্ধে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। সংগ্রামী মায়ের কারণে তিন কন্যাই স্নাতকোত্তর শেষ করতে পেরেছেন। কিন্তু অনেক পরিবার উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে।

মার্ক্সবাদের মতো একটা মহান আদর্শের ভুল ব্যাখ্যা সমাজের একটি অংশকে বিপথগামী করার পাশাপাশি হাজার হাজার পরিবারের কতটা সর্বনাশ ঘটাতে পারে, ওইসব চরমপন্থি এবং গোটা দক্ষিণাঞ্চলে তাদের শিকার ব্যক্তিরা তার প্রমাণ।

আশার কথা, সেই অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরতে শুরু করেছে বিপথগামী অনেকে। সোমবার সমকালে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সিরাজগঞ্জে ৩১৫ চরমপন্থি আত্মসমর্পণ করেছে। মেহেরপুর, রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, টাঙ্গাইল ও নাটোরের এসব চরমপন্থি আত্মসমর্পণকালে ২১৩টি আগ্নেয়াস্ত্রও জমা দিয়েছে। এই ইতিবাচক উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম চরমপন্থিদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যোগ্যতা অনুযায়ী অনেকেরই কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সে ধারাটি অব্যাহত রেখেছেন। এর আগে আমরা দেখেছি তাঁর কাছে কয়েক ধাপে সুন্দরবনের জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ করতে। আশা করি, সব চরমপন্থিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

সত্তর দশকে বরিশাল, শরীয়তপুর থেকে শুরু করে যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এমনকি উত্তরবঙ্গের অনেক জেলায় চরমপন্থিদের সক্রিয়তা লক্ষ্য করা গেছে। পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি আন্দোলনের নেতা চারু মজুমদারের ভাবধারায় এ দেশে বিভিন্ন নামে অসংখ্য চরমপন্থি সংগঠনের জন্ম হয়। আশি ও নব্বইয়ের দশকে এসে তাদের বর্বরতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ সময় তারা শ্রেণিশত্রু খতমের নামে নিজেদের দলেরই ভিন্নচিন্তার সদস্যদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। মানুষ খুনের উৎসবে মেতে উঠে পরিচিতি পায় গলাকাটা বাহিনী হিসেবে। এমনকি ছিনতাই, ডাকাতি, লুটতরাজের মতো অপরাধে জড়িয়ে যায় তারা এবং ভাড়াটে খুনির তালিকায়ও নাম লেখায় কেউ কেউ। সমাজতন্ত্রের বুলিধারী বিপথগামী এসব ব্যক্তির কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয় একের পর এক সরকারকে।

এখন যদিও চরমপন্থিরা আগের মতো সক্রিয় নয়। তারপরও বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলে মাঝেমধ্যে তাদের তৎপরতার খবর সংবাদমাধ্যমে আসে। নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা অঘটনের মধ্য দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। ব্যাপক পরিসরে কর্মকাণ্ড না থাকলেও চরম পন্থা এখনও যে নির্মূল হয়নি– তা আরও স্পষ্ট হয়েছে সিরাজগঞ্জে ৩১৫ জনের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। এখন সময় এসেছে ভুল তত্ত্বের জালে বন্দি এসব মানুষকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার।

ভুল তত্ত্বের ফাঁদে ফেলার ঘটনা এ দেশে নতুন নয়। এখনও একটি চক্র তরুণ সমাজকে জিহাদের নামে উগ্রবাদে যুক্ত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। অশিক্ষিত কিংবা মাদ্রাসাপড়ুয়া শিক্ষার্থীর পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। গুলশানে হলি আর্টিসানে হামলার সময় এক দল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সন্ধান পাওয়া গেছে। অথচ তাদের কারও কারও বাবা ঘটনার সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতা ছিলেন। ডান বা বাম যে কোনো চরম পন্থাই সমাজের জন্য অশুভ। তাই পুনর্বাসনের পাশাপাশি এমন অশুভ শক্তি তৈরির পথও যাতে বন্ধ করা যায়, সে জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি নিতে হবে সরকারকে।

মিজান শাজাহান: সহ-সম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com