- মতামত
- নদীটি উদ্ধার করুন
নদীটি উদ্ধার করুন
নদী দখল এই নদীমাতৃক দেশেও বিরল নহে। কিন্তু হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে শুটকি নদী যেইভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবিশেষ প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল দখল করিয়া রাখিয়াছে, উহা যদ্রূপ বেদনাদায়ক তদ্রূপ বিস্ময়কর। আরও উদ্বেগজনক, ভোগদখল নিশ্চিত করিতেই উহাকে ‘বদ্ধ’ জলাশয় আখ্যা দেওয়া হইতেছে। অথচ আমরা জানি, উহা রীতিমতো প্রবহমান নদী; কালনী নদীর শাখা-প্রশাখা ও সংলগ্ন বিল অঞ্চল হইতে উৎপন্ন হইয়া শুটকি নদী হবিগঞ্জেই রত্না নদীতে মিশিয়াছে। সমকালের প্রতিবেদকও চাক্ষুষ করিয়াছেন, কীভাবে মৌসুমি শ্রমিকরা নৌকাবোঝাই ধান লইয়া সিলেট অঞ্চল হইতে সুদূর সিরাজগঞ্জে চলিয়াছে। ইহার পরও নদীটি বদ্ধ জলাশয় হইবার কোনো কারণ থাকিতে পারে না। অপরদিকে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন যেইভাবে নদীটি ব্যক্তিমালিকানা হইতে উদ্ধারকল্পে ‘বদ্ধ জলাশয়’ দেখাইয়া ব্যক্তির নামে ইজারা দিয়াছে, উহাও যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। ইহা যেন জ্বর সারাইতে কুইনাইন দিয়া পরবর্তী সময়ে কুইনাইন সারাইবার বিপাক। নদীটি ও উহার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক আমাদের মধ্যে সন্দেহ নাই, শুটকি প্রবহমান নদী মাত্র; কোনোক্রমেই বদ্ধ জলাশয় হইতে পারে না।
বস্তুত সোমবার সমকালে প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে শুটকি নদীর এইরূপ বিরল সংকটের বিস্তারিত উঠিয়া আসিয়াছে। দেখা যাইতেছে, নদীটা ইয়াহিয়া ফিশ ইন্ডাস্ট্রি নামে এক কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রহিয়াছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী বানিয়াচংয়ের সাবেক জমিদার আলী আহমদ রাজার পরিবার। সমকালের প্রতিবদকের নিকট ঐ পরিবার দাবি করিয়াছে, উহা নদী নহে; কৃত্রিমভাবে খননকৃত খাল বা জলাধার মাত্র। অথচ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে নদনদীর তালিকায় শুটকি নদীর নাম রহিয়াছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীও বলিয়াছেন, শুটকি অবশ্যই প্রবাহিত নদী; আদৌ বদ্ধ জলাভূমি নহে। এমনকি পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৮ সালে হাওরের জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে শুটকি নদীর ৪ কিলোমিটার এলাকা খনন করিয়াছে। যদি উহা ব্যক্তিমালিকানাধীন ‘জলাধার’ই হইবে, তাহা হইলে রাষ্ট্রীয় অর্থে খনন করিবার হেতু কী? বর্ষায় হাওরের পানি নিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যম এবং শুষ্ক মৌসুমে নৌপথরূপে ব্যবহৃত নদীটি এইভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হইতে পারে না। সামষ্টিক এই সম্পদের সদ্ব্যবহারের বদলে একটি পরিবার উহার মৎস্যসম্পদ ও উত্তোলনযোগ্য বালু হইতে লাভবান হইতে থাকিবে, আর এলাকাবাসী নয়ন ভরিয়া দেখিবে? রাষ্ট্রই বা রাজস্ব হইতে বঞ্চিত হইবে কেন? এই ক্ষেত্রে আদালতে চলমান মামলার কথা বলা হইতেছে। উহা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি এবং জনগণের সম্পদ তাহাদের সদ্ব্যবহারের জন্য অবিলম্বে ফিরাইয়া দেওয়া আবশ্যক।
আমরা মনে করি, শুটকী নদীকে সর্বাগ্রে ‘নদী’ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হইবে। হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন উদ্যোগী হইলে এই স্বীকৃতি দুঃসাধ্য হইতে পারে না। শুটকি নদী উদ্ধারে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনও ইতিবাচক ভূমিকা রাখিতে পারে। আমরা বিস্মিত, এই কমিশনের ওয়েবসাইটে নদনদীর তালিকায় শুটকি নদীর নাম থাকিলেও দখলকৃত নদী ও দখলদারের তালিকায় শুটকি নদীর নাম কিংবা ইয়াহিয়া ফিশ ইন্ডাস্ট্রি বা আহমদ রাজার নাম কেন নাই? বলাবাহুল্য, বানিয়াচং উপজেলা ভূমি অফিসের দলিল-দস্তাবেজে নদী হিসাবেই শুটকি রেকর্ডে জাজ্বল্যমান। নদীটা উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রশাসনের সদিচ্ছার প্রশ্ন এইখানে স্পষ্ট।
আমরা জানি, দেশের অধিকাংশ নদী দখল-দূষণে বিপর্যস্ত। যখন মানুষ ও পরিবেশের স্বার্থে নদীগুলি উদ্ধার জরুরি; এমন সময়ে জলজ্যান্ত নদীকে ‘বদ্ধ জলাশয়’ হিসাবে চিহ্নিতকরণ মানিয়া লইবার অবকাশ নাই। মনে রাখিতে হইবে, শুটকি নদী দেশের অনেক নদী অপেক্ষা সুস্থ আছে এবং সময় ফুরাইয়া যাইবার পূর্বেই ইহাকে উদ্ধার করা জরুরি। ইহাকে ‘বদ্ধ জলাশয়’ নামে ব্যক্তিগত মালিকানায় ছাড়িয়া দিলে অপরাপর নদীর ক্ষেত্রেও এই নিকৃষ্ট নজির ব্যবহৃত হইতে থাকিবে। দখলকারী পরিবারকেও অনুধাবন করাইতে হইবে– জমিদারি উঠিয়া গিয়াছে। স্বাধীন দেশে পরাধীন যুগের গায়ের জোর চলিতে পারে না।
মন্তব্য করুন