পূর্ব ইউক্রেনীয় শহর বাখমুত রাশিয়ার বাহিনী দখল করেছে।  ২২০ দিনেরও বেশি সময় ধরে ঘরে ঘরে লড়াইয়ের পর এই বিজয় এসেছে। প্রশ্ন হলো, এই বিজয় রাশিয়ার জন্য কতটা আনন্দের হবে? এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধগুলোর অন্যতম এই বাখমুত যুদ্ধ; এটি সবচেয়ে রক্তক্ষয়ীও হতে পারত। রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ গত মাসে ইউক্রেনে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার মানুষ মারা গেছে বলে অনুমান করেছে, যদিও প্রোপাগান্ডা সাইটগুলো ৪০ হাজার পর্যন্ত বলেছে। যাই হোক না কেন, সম্ভবত বাখমুতের ৭০ হাজার বাসিন্দার চেয়েও বেশি লোক এ যুদ্ধে হতাহত হয়েছে। শহরটির সব লোক এখন প্রায় সম্পূর্ণভাবে পালিয়েছে; তবে বিভিন্ন ভবনের নিচে কিছু লোক লুকিয়ে থাকতে পারে।

বাখমুতের ক্ষয়ক্ষতি ফ্রান্সের ভার্দুনের ক্ষতির চেয়ে যথেষ্ট কমই হয়েছে, বলা চলে। ভার্দুন যুদ্ধের ফলস্বরূপ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৭ লাখ হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। যদিও ইউক্রেনীয়রা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বাখমুতের পরাজয় স্বীকার করেনি, তারা এই যুদ্ধকে রাশিয়ার সেই ছোট শহরের লড়াইয়ের সমতুল্য মনে করে। ফ্রান্সের ওই শহরের যোদ্ধারা আক্রমণকারী জার্মান সেনাবাহিনীকে বেঁধে রেখেছিল। ইউক্রেনের সামরিক মুখপাত্র এবং বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে বাখমুতের দীর্ঘায়িত, ব্যয়বহুল যুদ্ধ করার জন্য এটি একটি যুক্তি ছিল। রাশিয়ানরা তাদের পক্ষ থেকে একই রকম পাল্টা দাবি করেছে, রাশিয়ান কমান্ডাররা, বিশেষ করে ওয়াগনার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভজেনি প্রিগোজিন ইচ্ছাকৃতভাবে ইউক্রেনীয়দের বাখমুতে প্রলুব্ধ করেছিল। একটি পাল্টা আক্রমণে যতটা সম্ভব ইউক্রেনে থাকা পশ্চিমা সরঞ্জাম হ্রাস করবে।

ক্রেমলিনপন্থি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সের্গেই মার্কভ তাঁর টেলিগ্রাম চ্যানেলে লিখেছেন, ‘তারা বাখমুতের একটি আধা-বেষ্টনী তৈরি করেছে। এটি একটি চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত ছিল। এটি (ইউক্রেনের  প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির) জেলেনস্কির জন্য একটি বিভ্রম তৈরি করেছিল যে, বাখমুতকে রক্ষা করা যেতে পারে। জেলেনস্কি এতে আরও বেশি করে ইউক্রেনীয় সামরিক শক্তি সেখানে নিয়োজিত করেন এবং ওয়াগনার তাদের ধ্বংস করতে থাকে।’

উভয় পক্ষই যুদ্ধের এই পর্যায়কে ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করছে অন্তত ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণ শুরুর আগে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র অংশে কেন লড়াইটা তীব্র হলো, তা কেউই বলছে না। রাশিয়ান আক্রমণকারীরা লড়াইয়ের জন্য খারকিভ বেছে নিতে পারত। কারণ তারা একবার সেটা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর পিছু হটে। খারকিভে পুনরায় যুদ্ধ করার একটা যুক্তি থাকত, যাতে তারা আবার ইউক্রেনীয় দুর্গ যেমন স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামতোরস্ককে ঘেরাও করে হুমকি দিতে পারে। রাশিয়ানরা জাপোরিঝিয়া অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর চেষ্টাও করতে পারত। এ অঞ্চলকে ক্রেমলিন ইতোমধ্যে রাশিয়ান অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে। এমনকি তারা রাশিয়া-অধিকৃত ইউক্রেনের বৃহত্তম শহর দোনেৎস্ক থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে আরও দূরে ঠেলে দেওয়ার জন্য ওয়াগনারকে পাঠাতে পারত। দোনেৎস্ক সম্মুখ অংশ থেকে ১৫ কিলোমিটারের বেশি দূরে নয়; দোনেৎস্ককে ইউক্রেনীয় অস্ত্রের বিস্তৃত পরিসরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা যেত। এর পরিবর্তে তারা বাখমুতকে বেছে নিয়েছিল, যার মধ্যে আর্টওয়াইনারির মাদকের বোতল সংরক্ষণ করা হয়েছিল এবং তার মতো সুড়ঙ্গের একটি বড় নেটওয়ার্ক ছিল।
ইউক্রেনীয়রাও বাখমুতকে ত্যাগ করে রাশিয়ার যুদ্ধের দুর্বলতা খোঁজার জন্য সৈন্যদের ব্যবহার করতে পারত। যেমনটি তারা খারকিভ অঞ্চলের একটি বিশাল অংশ পুনরুদ্ধারের জন্য করেছিল।

ওয়াগনার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের ব্যবসায়িক উচ্চাকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি এখন দৃশ্যত রাজনৈতিক পরিকল্পনা দৃশ্যমান। সেটাই সম্ভবত রাশিয়ার বাখমুতে অটল থাকার প্রধান কারণ ছিল। খারকিভ অঞ্চলের পরাজয় এবং দক্ষিণ ইউক্রেনের খেরসন থেকে জোরপূর্বক বিতাড়নের ফলে হতাশ হয়ে পড়া নিয়মিত রুশ সামরিক বাহিনীকে পুনরায় সংগঠিত করতে; কয়েক হাজার নতুন নিয়োগপ্রাপ্তকে প্রশিক্ষণ দিতে; অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে; আধুনিক ড্রোন যুদ্ধের বাস্তবতার প্রয়োজনে বাখমুত জয় জরুরি ছিল। অন্যভাবে বলতে গেলে, যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে, রাশিয়ানরা বলা চলে সেটাই করেছে।
ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের ব্যক্তিগতভাবে একটি জয়ের প্রয়োজন ছিল, যাতে সে তার উচ্চ প্রভাব বজায় রাখতে পারে এবং তার ব্যক্তিগত সেনাবাহিনীর জন্য ক্রেমলিনের আস্থা অর্জন করতে পারে। সে জন্যই ওয়াগনার বাহিনী সর্বশক্তি দিয়ে অব্যাহতভাবে আক্রমণ করেছিল। প্রথমে ইউক্রনের লবণ খনির শহর সোলেদার এবং তার পরে বাখমুতে তারা যুদ্ধ করেছিল। প্রিগোজিন এখন বলছেন, তাঁর বাহিনী পুনর্নির্মাণের জন্য ফিরে আসবে। ওয়াগনার সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের অপরাজিত রেখে চলেছেন, যা কিংবদন্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

ইউক্রেনের দিক থেকে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নিশ্চিত করেছেন, বাখমুত একটি প্রতীকী মর্যাদা অর্জন করেছে। এমনকি এখনও তারা বলছে যে, বাখমুতে রাশিয়ান বাহিনী ‘আধা-বেষ্টিত’ অবস্থায় রয়েছে। এমন দাবি ইউক্রেনীয় মনোবলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, বিমানসহ আরও অত্যাধুনিক পশ্চিমা অস্ত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে জেলেনস্কির জন্য বাখমুতের পতন ভালো বিষয় নয়।

এর পর কী হবে, সেটা দখলদার বাহিনী একটা ধাঁধা হিসেবে রেখেছে। কখন ইউক্রেনীয় পাল্টা আক্রমণ আসবে? কেন জেলেনস্কি বহুল প্রচারিত বিদেশ ভ্রমণ করতে যথেষ্ট নিরাপদ বোধ করেন? ইউক্রেনীয় বাহিনী দোনেৎস্ক বা এমনকি রাশিয়ান শহর বেলগোরোডের বিরুদ্ধে গণসংযোগ করছে– এমন গুজব রাশিয়ার সৈন্যদের মোকাবিলা করতে হবে। এক বছর এবং তিন মাসের মধ্যে একটি পাল্টা সেনা অভিযান হবে– এমন অবস্থা এখন নেই। তবে ইউক্রেন যেহেতু এখনও বাখমুতের আশা ছাড়েনি; রাশিয়ান বাহিনীর জন্য এখনই বিজয় উদযাপন করা খুব তাড়াতাড়ি হবে।

লিওনিদ বারশিদস্কি : রাশিয়ার সাংবাদিক,  ব্লুমবার্গ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক