ডিজিটাল যুগে মানুষের, বিশেষত নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কতটা হুমকির সম্মুখীন; মঙ্গলবার সমকালের এক প্রতিবেদন উহা পুনরায় উন্মোচিত করিল। প্রতিবেদন অনুসারে, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি একটি অপরাধচক্রের কয়েকজন সদস্যকে সম্প্রতি আটক করিয়াছে। তাহারা ফেসবুক আইডি হ্যাকের মাধ্যমে সংগৃহীত তরুণীদিগের ছবি ও ভিডিও অশালীন ছবিতে বসাইয়া সামাজিক মাধ্যমে ছড়াইবার হুমকি দিয়া ভুক্তভোগীগণের নিকট হইতে অর্থ আদায় করিত। উপরন্তু অর্থদানে অপারগ ভুক্তভোগীগণের নিজদিগের গোপন ভিডিও ধারণপূর্বক চক্রটির নিকট প্রেরণে বাধ্য করা হইত এবং এই সকল ভিডিও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টেলিগ্রাম গ্রুপে ছাড়া হইত, যেই সকল গ্রুপে মাসিক নির্ধারিত ফি পরিশোধকারী কয়েক লক্ষ সদস্য রহিয়াছে। সিআইডিপ্রধানের বরাতে আলোচ্য প্রতিবেদনে আরও বলা হইয়াছে, গ্রেপ্তারকৃত চক্রটির নিয়ন্ত্রণে ২০ সহস্রাধিক আপত্তিকর ভিডিও এবং ৩০ সহস্রাধিক ছবি পাওয়া গিয়াছে। সিআইডি তো মাত্র একটি চক্রের সন্ধান পাইয়াছে। ডিজিটাল দুনিয়ায় অনুরূপ আরও কত চক্র যে সক্রিয়, উহার হিসাব কে রাখে? আর ঐ সকল চক্রের হীন তৎপরতায় কত নারীর জীবন যে বিষাইয়া উঠিয়াছে, তাহারই বা খোঁজ কে জানে?

এইরূপ আশঙ্কাও অমূলক হইতে পারে না, একজনের অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে গিয়া সিআইডি চক্রটির সন্ধান পাইলেও, বহু ভুক্তভোগী রহিয়াছেন, যাঁহারা প্রতিকারের আশায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হন না। কারণ হিসাবে প্রথমেই বলিতে হয় লোকলজ্জার কথা। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে নারী সম্পর্কে এমন অনেক ‘ট্যাবু’ রহিয়াছে, যেইগুলির কারণে যৌন নির্যাতন তো বটেই; যেই কোনো নিগ্রহের ঘটনা প্রকাশ করিবার সাহসও পায় না। এই সমাজে একদিকে নিগ্রহের জন্য ভুক্তভোগীকেই দায়ী করিবার, আরেক দিকে নিগৃহীত নারীকে এড়াইয়া চলিবার প্রবণতা প্রবল। যেই কোনো প্রকার যৌন নিগ্রহের শিকার বিবাহিত নারীর সংসার কিংবা অবিবাহিত নারীর বিবাহ ভাঙিয়া যাওয়ার ঘটনা এই সমাজে বিরল নহে।

সম্ভবত সমাজের নিদারুণ বাস্তবতা বোঝাইতে গিয়াই গত বছরের ১৬ জুন পুলিশের সাইবার সাপোর্ট ফর ওমেন উইংয়ের ডেটাবেজের বরাত দিয়া একটি ইংরাজি দৈনিকের বাংলা পোর্টালে লেখা হইয়াছিল, ব্ল্যাকমেইলসহ বিবিধ সাইবার অপরাধের প্রায় ৫ হাজার ২৯৮ জন নারী ভুক্তভোগী আইনের আশ্রয় লইবার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন নাই। অথবা ঘটনা জানাইলেও এক পর্যায়ে পুলিশকে প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া বন্ধ করিয়া দেন। বলা বাহুল্য নহে, যেই অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডির সাম্প্রতিক তৎপরতা, উহা কিন্তু দায়ের করিয়াছেন ভুক্তভোগী নারী নহে, তাঁহার প্রেমিক। অর্থাৎ ভুক্তভোগী নারী নিজে প্রকাশ্যে প্রতিকার চাহিবার সাহস পান নাই। অবশ্য সাহস করিয়া পুলিশকে ঘটনা জানাইলেই যে ত্বরিত প্রতিকার মিলে, তাহা নহে।

যেমন গত বৎসরের ২৫ মার্চ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেসরকারি নজরদারি প্রতিষ্ঠান সাইবার লাইন পরিচালিত এক অনলাইন জরিপ বলিতেছে, পুলিশের সাহায্যপ্রার্থী সাইবার অপরাধের শিকার প্রায় ৮৪ শতাংশ নারীর অভিযোগ তখন অবধি অমীমাংসিত রহিয়াছে। এ পরিস্থিতি যেই সাইবার অপরাধের বিশেষত নারী ভুক্তভোগীগণের মুখ খুলিবার অনকূল নহে, তাহা ব্যাখ্য করিবার প্রয়োজন নাই।

স্মরণে রাখিতে হইবে, প্রাযুক্তিক বিস্ফোরণের এই যুগে মানুষের জীবন ক্রমবর্ধমান হারে অনলাইননির্ভর হইয়া পড়িতেছে। উহার অনিবার্য ফলস্বরূপ একান্ত ব্যক্তিগত তথ্যাদিও তাহারা এখন স্মার্টফোন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য ডিভাইসে সংরক্ষণ করিতেছে। ফলে ইহাকে কেন্দ্র করিয়া নানা ধরনের অপরাধ চক্র গড়িয়া ওঠা অস্বাভাবিক নহে। আলোচ্য ঘটনায় তাই আমরা বিস্মিত নই। তবে ইহা স্বীকার করিতে হইবে, অবিলম্বে এই প্রকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনিতে না পারিলে ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনই শুধু তছনছ হইবে না; সমাজে শৃঙ্খলাও নাজুক হইয়া পড়িবে। আমরা মনে করি, এক্ষণে ডিজিটাল ডিভাইসের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের পরামর্শ কোনো কাজে আসিবে না; বরং সাইবার অপরাধের ফাঁদ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়িয়া তুলিবার পাশাপাশি অপরাধচক্রের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে।

বিষয় : নেহাত ব্যক্তিগত নহে সম্পাদকীয়

মন্তব্য করুন