
চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী মিছিলের অগ্রভাগে থেকেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকির প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবেই পালন করছিলেন। কিন্তু তিনি যেভাবে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা নিন্দার্হ এবং বেআইনি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভালো কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তিনি সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এই অঘটনসূত্রে সংবাদমাধ্যম তাঁর ঠিকুজিও বের করে এনেছে। বুধবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদনের শিরোনাম– ‘বিতর্ক যেন নিত্যসঙ্গী এমপি মোস্তাফিজের’।
দু’বারের এই সংসদ সদস্য কাউকে গুলি করেননি; পিস্তলটিও হয়তো অবৈধ নয়। কিন্তু তিনি যেভাবে মিছিলে অস্ত্র প্রদর্শন করছিলেন, সেখানেই আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে। এমনকি পুলিশের সামনেই তিনি এমন বেআইনি কাজটি করেছেন। এর মাধ্যমে স্পষ্টত তিনি তাঁর ক্ষমতার দাপটই দেখিয়েছেন। সেই দাপটেই তিনি বারবার বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করে আসছেন। এর আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পছন্দমতো ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা নিয়োগ না দেওয়ায় ২০১৬ সালে তিনি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার ওপর চড়াও হন। তাঁকে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুসি মারতেও দ্বিধা করেননি। দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক, পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ অনেককেই তিনি গালাগাল করেছেন। সর্বশেষ সোমবার তিনি অস্ত্র প্রদর্শন করে মহড়া দিয়েছেন।
অবশ্য কেবল মোস্তাফিজুর রহমানই নন; আজ অবধি বর্তমান সংসদের অনেক সদস্যের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত হয়েছে ক্ষমতাসীন দল। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে প্রকাশ্যে মারধরের অভিযোগ ওঠে রাজশাহী-১ আসনের সরকারদলীয় এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে। কুমিল্লা-৪ আসনের এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদকে পুরোনো এমপি হোস্টেলে মারধর করেছেন। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দিন কলেজের দুই সহকারী অধ্যাপককে পেটানোর অভিযোগ ওঠে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের বিরুদ্ধে। বরগুনা-২ আসনের সরকারদলীয় এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমন সালিশ বৈঠকে ফোরকান মিয়া নামে এক মাছ ব্যবসায়ীকে থাপ্পড় মারেন। এর বাইরে সংসদ সদস্যদের ছায়ায় থেকে দলীয় নেতাকর্মীর অপরাধের ঘটনা তো রয়েছেই। এমনই এক ঘটনায় গত বছর বরিশাল-৪ এর সংসদ সদস্য পংকজ নাথকে সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু এমন শাস্তির উদাহরণ ওই একটিতেই সীমাবদ্ধ। যে কারণে সংসদ সদস্য অনেকেই বেপরোয়া।
একজন সংসদ সদস্য এমনিতেই ক্ষমতাবান। উপরন্তু তাঁর সঙ্গে মিছিলে নেতাকর্মী ছিলেন এবং তাঁদের সুরক্ষায় রয়েছে পুলিশ বাহিনী। এর পরও মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী পিস্তল প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন! একজন আইনপ্রণেতার বিরুদ্ধে বেআইনি অস্ত্র প্রদর্শনের জন্য আইনি কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার মানে হলো, সাধারণ মানুষের জন্যই কেবল আইন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একটা সরকারের জন্য মোটেই তা সুখকর কিছু নয়।
আলোচ্য সংসদ সদস্য কেবল ক্ষমতার দাপট প্রদর্শনেই পটু নন; রাজনীতি যে অনেকের জন্য আলাদিনের চেরাগ হিসেবে কাজ করেছে, সেখানেও তিনি পিছিয়ে নেই। সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে, সংসদ সদস্য হওয়ার পর গত ১০ বছরে তাঁর সম্পদ বেড়েছে ১৪ গুণ এবং তাঁর স্ত্রীর বেড়েছে চার গুণ। আগে তাঁর কোনো গাড়ি না থাকলেও এখন তিনি কোটি টাকার গাড়ি ব্যবহার করেন। সব ক্ষেত্রেই তিনি এগিয়ে। হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার এমন ঘটনা তাদের চোখের সামনে ঘটলেও দুদকের কোনো নড়াচড়া নেই। অবশ্য রাজনীতির চরম অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অস্ত্র ও সম্পদ যেখানে অন্যতম হাতিয়ার, সেখানে মোস্তাফিজুর রহমানদেরই জয় হবে– এটাই স্বাভাবিক। এভাবেই হয়তো তাঁরা দাপুটে হিসেবে জাতীয়ভাবে পরিচিত হবেন এবং বৈষয়িক উন্নতির শিখরে উঠবেন।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com
মন্তব্য করুন