আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে এখনই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। বিশেষ করে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে সংঘাত ও সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন অনেকে। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা, নির্বাচনকালীন সরকার, জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সমকাল কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরীর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার দুটি নিয়েছেন সমকালের সহ-সম্পাদক এহ্‌সান মাহমুদ।

সমকাল: নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নানা রকম আলোচনা শোনা যাচ্ছে। আপনার ভাবনা জানতে চাই।

হারুন-অর-রশিদ: আগামী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে যে সন্দেহ-অবিশ্বাস, তার সঙ্গে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিবিড়ভাবে জড়িত। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনেই হয়েছিল। সেই নির্বাচনে ১০-১২টি আসনে অনিয়ম হয়েছিল। এ ছাড়া আর সবক’টি আসনেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফলে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারের সদস্যদেরসহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এর পর দেশ জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অধীনে চলে যায়। এইসব সেনাশাসন দেশ যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেনাশাসনের আমলে যেভাবে নির্বাচন হয়েছে– বিশেষ করে, হ্যাঁ ভোট ও না ভোট, তা নিয়েও কথা আছে।

সমকাল: গত দুইটি নির্বাচন সম্পর্কে বলুন...

হারুন-অর-রশিদ: এখানে একটি বিষয় বুঝতে হবে। যখন দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয়; জ্বালাও-পোড়াও করে, তখন তার একটি প্রভাব ভোটে পড়বে। এর জন্য বিএনপির অদূরদর্শিতা এবং নেতৃত্বের সংকট দায়ী।

সমকাল: এবার তাহলে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে?

হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি আমলে মাগুরার উপনির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে একটি বাজে দৃষ্টান্ত হিসেবে হাজির হয়েছে। সেই সময়ে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালে দেশে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আনা হয়েছিল। এর পর বিএনপির আমলেই আবার এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছিল। ২০০৪ সালে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতিদের বয়স বাড়ানোর মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে দলীয় করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। বিএনপির এক সময়ের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার জন্যই বয়স বৃদ্ধি করে প্রধান বিচারপতি হওয়ার সুযোগ রাখা হলো। এর পর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলেন। ফলে আওয়ামী লীগ আবার আন্দোলনে গেল। ওয়ান-ইলেভেন সরকার ক্ষমতায় এলো। পরে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলো। এই যে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার ক্ষমতায় এলো, এর মূলে রয়েছে বিএনপির অপরাজনীতি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেতনাবিরোধী অপরাজনীতির কারণেই এই ব্যবস্থাটি ধ্বংস হয়ে গেল।

সমকাল: ২০০৮ সালের যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়, সেটিও তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। তাহলে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন কেন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে করা গেল না, যেখানে আদালতের এক ধরনের পর্যবেক্ষণও ছিল?

হারুন-অর-রশিদ: সারা দুনিয়াতেই একটি বিধান– দলীয় সরকারের অধীনে যখন নির্বাচন হয়, তখন তারা কেবল রুটিন কাজ করে।

সমকাল: বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা দলটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময়ে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকে। বিপরীতে, বিরোধীরা সাধারণ প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে থাকেন। তাহলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কীভাবে নিশ্চিত হবে? 

হারুন-অর-রশিদ: এর জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ বা আরপিও সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা আছে। কেননা, একজন সংসদ সদস্য সব সরকারি সুবিধা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন, কিন্তু একজন সাধারণ প্রার্থী সেই সুবিধা পাবেন না, এটা হওয়া উচিত নয়। এ জন্য দরকারি সংশোধন করা উচিত।

সমকাল: তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিরোধীদের দাবি নিয়ে কী বলবেন?

হারুন-অর-রশিদ: আমরা জানি, ২০১১ সালেই বাংলাদেশে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেছে। সেই সময়ে অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এটাও বলেছিল– তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন হতে পারে। এ ছাড়া আদালত উল্লেখ করেছেন, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ রেখে সংসদ এ সরকার পদ্ধতি সংস্কার করতে পারে।

সমকাল: কিন্তু সেটা তো আমলে নেওয়া হয়নি।

হারুন-অর-রশিদ: এখন একটা বিষয় বুঝতে হবে, আমাদের মতো দেশে সবকিছু আইন অনুযায়ী শতভাগ প্রতিফলিত হয় না। এখানে রাজনৈতিক খেলা কাজ করে। রাজনৈতিকভাবে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ– এই দুটি দলের যেমন ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি জনমত তৈরি কিংবা মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি বিষয় আছে। আমরা এর আগে দেখেছি, আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়কের দাবি আদায়ে মাঠ নিজেদের দখলে নিয়েছিল। বিএনপির এমন কিছু তো দেখা যায়নি।  

সমকাল: আপনি কি তাহলে সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন?

হারুন-অর-রশিদ: বাংলাদেশের রাজনীতি হচ্ছে সাংঘর্ষিক। এই সংঘর্ষের মূলে রয়েছে ১৯৭১ এবং ’৭৫। একাত্তরে এক দল স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল। তারাই এখন রাজনীতিতে একটি দলে সক্রিয়। আবার পঁচাত্তরে যারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদের রাজনীতি। সাংঘর্ষিক রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করা কঠিন। আমরা একটি কঠিন সময়ের মধ্যে পড়েছি। এখান থেকে উত্তরণে অনেক সময় লাগবে। বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা মূলত দুটি। একটি হলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ এবং এর শরিক ও সমমনা দল। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতকেন্দ্রিক যে জোট। এই দুই মেরু নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি বিভক্ত।

সমকাল: কিন্তু আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকার পরও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না। আবার হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য প্রকাশ পাচ্ছে।

হারুন-অর-রশিদ: আমি ব্যক্তিগতভাবে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে। আর হেফাজতের সঙ্গে সরকারের যে সম্পর্ক, এটিকে রাজনৈতিক হিসেবেই আমি অভিহিত করতে চাই। রাজনীতি করতে গেলে নানা কৌশল দরকার হয়। এটাও কৌশল। যেমন এখানে বলা যায়, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছিল? হয়নি। সেটা শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালে। তেমনি কখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে, এটাও একটা কৌশল।

সমকাল: জামায়াত তো তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

হারুন-অর-রশিদ: তৎপরতা যা-ই থাকুক; বিএনপি-জামায়াত এক পক্ষেই যাবে। জোট কীভাবে হবে, সেটা বলা মুশকিল। কারণ আমরা ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে দেখেছি, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল এবং তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেছিল। সুতরাং, এবার বিএনপি কোন ফর্মে নির্বাচনে যায় সেটিও দেখার বিষয়। তবে তাদের সঙ্গে যে জামায়াত থাকবে– সেটি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপির জোট গঠন করার চেয়ে জনসমর্থন অর্জনের দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার– বিএনপির এসব দাবির ব্যাপারে জনগণের সাড়া নেই।

সমকাল: বিএনপির বিভাগীয় সম্মেলনগুলোতে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল।

হারুন-অর-রশিদ: বিএনপি তো ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া দিয়েছিল। কিন্তু সেসব দাবি তারা আদায় করতে পারেনি। কারণ জনসমর্থন ছিল না। জনসমর্থন ছাড়া শুধু জোটবদ্ধ হয়ে কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব নয়। তারা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে; তাদের সমর্থন পেতে পারে। কিন্তু জনসমর্থন পাওয়া সম্ভব নয়।

সমকাল: আগামী নির্বাচন কীভাবে হবে বলে আপনার ধারণা?

হারুন-অর-রশিদ: নির্বাচন হবে সংবিধান অনুসারে। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু যখন নির্বাচন গিয়েছিলেন তখন দেশের ক্ষমতা তাঁর হাতে ছিল না। কিন্তু তাঁর সঙ্গে জনগণ ছিল। গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে দেশে গণঅভ্যুত্থানের কোনো সম্ভাবনা নেই। বিএনপির অভ্যুত্থান সৃষ্টির মতো সামর্থ্য নেই।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।

হারুন-অর-রশিদ: সমকালকেও ধন্যবাদ।