
কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ব্যাপক বিজয় উত্তর-পূর্ব ভারতের তিনটি রাজ্য মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং নাগাল্যান্ডে পরাজয়ের পর অসাধারণ প্রাপ্তি। ওই তিনটি পরাজয়ে অনেকেই দলটির বিলীন হওয়ার কথা বলেছেন। এখন কর্ণাটকের জয়ে এটা স্পষ্ট– কংগ্রেসের পতনবিষয়ক তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল ভিত্তিহীন। দেশের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেসকে স্পষ্টত চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন কেউ নেই, তবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে কেবল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।
কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের বেশিরভাগ সমর্থক যে আশা করেছিল, তার চেয়েও দলটি ভালো ফল অর্জন করে। কংগ্রেস ১৩৫টি আসন লাভ করে, অর্থাৎ ৪২ শতাংশেরও বেশি ভোট তারা পেয়েছে। এটা বলা চলে, এই শতাব্দীর সর্বকালের সেরা বিজয়। কংগ্রেসের প্রচারণায় নিম্নবর্গের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাসহ সুশাসনের স্থানীয় বিষয়, উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জোর দেওয়া হয়। কংগ্রেস যে বিষয়গুলোর নিশ্চয়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করে সেগুলো ছিল সুনির্দিষ্ট, পরিকল্পিত এবং যথার্থ। বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে যে অসন্তোষ ছিল, সেটি কংগ্রেস অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। বিজেপির ‘৪০ শতাংশ কমিশন সরকারের’ বিপরীতে কংগ্রেস কাজ করার ‘শতভাগ প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছিল এবং সেই প্রতিশ্রুতিও পার্থক্য তৈরি করে। কংগ্রেস একই সঙ্গে রাজ্যের নেতৃত্বের দিক থেকেও সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল (তবে এটাই একমাত্র কারণ নয়), বিশেষ করে প্রাক্তন (এবং এখন পুনর্নিযুক্ত) মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া এবং তাঁর নতুন ডেপুটি তথা রাজ্য কংগ্রেসপ্রধান ডি কে শিবকুমারের কথা বলতেই হবে। কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃত্ব বিশেষ করে সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং গান্ধী পরিবারও গঠনমূলক ও ব্যাপকভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা রাজ্যের নেতাদের ওপর দমনমূলক না হয়ে সহযোগী ভূমিকা পালন করেছেন। সামগ্রিকভাবে বেশিরভাগ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক একমত– কর্ণাটক নির্বাচনে কংগ্রেস সব সঠিক বাক্সেই টিক দিয়েছে।
অন্যদিকে বিজেপি সেটি করতে পারেনি। কর্ণাটকে ক্ষমতায় থাকা বিজেপির কার্যকাল খুব ভালো ছিল না। বরং দুর্নীতি এবং অযোগ্যতা উভয়ই দেখা যায়, যা ভোটারদের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছিল। বিজেপি সরকার অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বেশ কয়েকটি খাতের জন্য সমালোচিত হয়েছিল। রাজ্যজুড়ে বিজেপি শাসনবিরোধী মনোভাব যে বিরাজ করছিল, তা সুস্পষ্ট। বিজেপির প্রথাগত কেন্দ্রীভূত রাজনীতি ব্যর্থ হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পরিচালিত বিজেপির দিল্লিভিত্তিক যে প্রচারণা সেখানে কর্ণাটকের নিজস্ব সমস্যার বিষয়গুলো ছিল না, যেগুলো কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্ব যথার্থভাবে তুলে ধরতে পেরেছিল। বিজেপি প্রথাগতভাবেই ‘ডাবল-ইঞ্জিন সরকার’ করতে চায়, যেটি একই সরকার দিল্লি এবং বেঙ্গালুরুতে কাজ করছে। এর বিকল্প হিসেবে ভোটাররা কংগ্রেসে আস্থা রেখেছে।
স্পষ্টতই কর্ণাটকে মেরূকরণের রাজনীতির ব্যর্থতাও ছিল। হালাল, হিজাব, ‘লাভ জিহাদ’, ‘ল্যান্ড জিহাদ’ ইত্যাদি হিন্দুত্ববাদী বার্তা, যা রাজ্যে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিভাজনের জন্য প্রচার করা হয়। এই কৌশল বাস্তবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি এবং স্থানীয় সমস্যা সমাধানের বিষয়, যেগুলো সরাসরি সাধারণ ভোটারের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত তার বিরুদ্ধে কাজ করেনি। বিজেপি টিপু সুলতানকে খারাপ বানানোর সম্ভাব্য চেষ্টা এবং তাঁকে হত্যাকারী হিসেবে দুই ভোকালিগা ঘাতকের বিষয় সামনে এনেছে (যদিও এমন দাবি হাস্যকর, যার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই) এবং এর মাধ্যমে একটি দল অতীতে আটকে গেছে। অথচ ভোটাররা উদ্বিগ্ন বর্তমান নিয়ে।
ভারতীয় ভোটাররা বাগ্যুদ্ধ এবং বিজেপির বার্তায় ক্লান্ত। ভোটাররা বরং সহজে তাদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার সুবিধা চায়; রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ব্যাপক, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে এবং বেকারত্ব সেখানে তুঙ্গে। সুতরাং সেগুলোই প্রাধ্যান্য পাওয়া উচিত। এটা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয় যে, কর্ণাটকে নারী ভোটারের ১১ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছে কংগ্রেস। মোদির ১০ বছর শাসনের পর তারা কি আবার দিল্লিতে পরিবর্তন চাইবে না, যেমনটি তারা কর্ণাটকে করে দেখিয়েছে?
কর্ণাটকে বিজেপির ভোটের কৌশল ছিল ক্লান্তিকর। গত দশকে দলটির পরীক্ষিত আবেদন হিন্দুত্ববাদী বার্তা, সাম্প্রদায়িক মেরূকরণের ভাষা প্রয়োগের চেষ্টা করেছে। তারা যে কল্যাণমূলক পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছে, তার জন্য ভোটারদের কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ভারতীয় রাজনীতি হলো একটা ব্যাংকের মতো, যেখানে কেবল বর্তমান হিসাবের লেনদেন হয়; আগের অর্জনগুলো ‘ফিক্সড ডিপোজিটে’ অদৃশ্য হয়ে যায়, যা ভোটারদের হিসাবে আর থাকে না। কারণ ভোটাররা প্রধানত তাদের বর্তমান অবস্থা এবং তাৎক্ষণিক বিষয় নিয়েই উদ্বিগ্ন। এ পরিস্থিতিতে বিজেপিকে ভোটারদের জন্য নতুন কিছু দেওয়া দরকার। ২০১৯ সালে যেমন পুলওয়ামা এবং বালাকোটের ঘটনা ছিল বিজেপির উপলক্ষ। ২০২৪ সালে তাদের এমন কোনো সঞ্চয় কি আছে?
২০১৯ সালে বিজেপি যেমন বেশ কয়েকটি রাজ্যে ভালো ফল করেছিল, সম্ভবত ২০২৪ সালে দলটি তেমন কিছু হবে– সে আশা করতে পারছে না। বিজেপি গুজরাট, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের প্রতিটি আসনে জিতেছে। বিহার, কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশে একটি আসন ছাড়া সবক’টি আসন জিতেছিল। এটি বাংলা ও মহারাষ্ট্রে সর্বকালের সেরা অর্জনের রেকর্ড করেছিল। এই রাজ্যগুলোর দৃশ্যকল্প থেকে বোঝা যায়, লোকসভায় তাদের আসন ২২০ থেকে ২৫০-এর মধ্যে নেমে যাবে, যদি তারা ২০১৯ সালে যেসব এলাকায় কম ভালো করেছে সেখানে প্রবেশ করতে সক্ষম না হয়। কিন্তু যেখানে তারা ইতোমধ্যে শক্তিশালী সেখানে তাদের অবস্থার উন্নতির খুব বেশি সম্ভাবনা নেই।
কর্ণাটকের ফল বিজেপিকে একটি প্রশ্ন অনুসন্ধানে বাধ্য করছে– পরবর্তী সময়ে দলটি ভারতীয় ভোটারের সামনে কিসের মুলা ঝুলাবে? দেখা যাচ্ছে, হিন্দুত্ববাদকে সামনে আনার পুরস্কার সীমিত হয়ে পড়ছে। কারণ মেরূকরণের মাধ্যমে দলটি জেতার সর্বোচ্চ সীমা কাজে লাগিয়ে ফেলেছে। সে জন্য নরেন্দ্র মোদির জন্য সর্বোত্তম সুযোগ হলো, ২০১৪ সালের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপলক্ষে ফিরে আসা। প্রযুক্তিগত ভারতের অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করছে। যখন একজন পাকিস্তানি ভিডিও-ব্লগার ভারতীয় চা বিক্রেতাদের সম্পর্কে বলেন, যিনি ভারতীয় পেটিএম কিউআর কোড দিয়ে ইন্টারনেটে লেনদেন করে অথবা ব্যাংকাররা ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস (ইউপিআই) পদ্ধতিকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী সুইফট থেকে ভালো বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, তখন বিজেপি এমন সাফল্যের কথা বলতে পারে, যার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিষ সমাজের শিরা-উপশিরায় ঢুকিয়ে দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি ইতিহাস কপচানো বা বিদ্বেষ ছড়ানোর নির্বাচনে জেতার জন্য আরও বিশ্বাসযোগ্য বার্তা। তবে বিজেপির কাছ থেকে এটি আশা করা খুব বেশি হয়ে যাবে।
শশী থারুর: ভারতীয় লেখক ও রাজনীতিক; দ্য হিন্দু থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
মন্তব্য করুন