- মতামত
- আঞ্চলিক আক্ষেপ
আঞ্চলিক আক্ষেপ

দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে যেই প্রকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়িয়া উঠিবার কথা ছিল; সার্ক প্রতিষ্ঠার চার দশক এবং দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হইবার দুই দশক পরও উহা দুর্ভাগ্যবশত সম্ভব হইয়া ওঠে নাই। সংগত কারণেই ঢাকায় বুধবার অনুষ্ঠিত ‘আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন: দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সার্কের গুরুত্ব’ শীর্ষক সম্মেলনে এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ হইতে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যে আক্ষেপই ফুটিয়া উঠিয়াছে। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-এফবিসিসিআই এবং সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি- এসসিসিআই আয়োজিত এই সম্মেলনে উৎসারিত আক্ষেপ যে যথার্থ, উহা প্রমাণিত হয় অন্যান্য আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক জোটের সহিত সার্কের বাণিজ্য পরিস্থিতি তুলনা করিলে। বিশ্বব্যাংক প্রদত্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়াছে, সার্কভুক্ত দেশসমূহের মোট বাণিজ্যের বড়জোর ৫ শতাংশ নিজেদের মধ্যে সংঘটিত হইয়া থাকে। অথচ প্রতিবেশী অঞ্চলের জোট আসিয়ানে নিজেদের মধ্যে সংঘটিত হইয়া থাকে মোট বাণিজ্যের ২৫ শতাংশেরও বেশি।
স্বীকার করিতে হইবে, এই অঞ্চলে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সড়ক, নৌ ও আকাশপথের পরিবহন ব্যবস্থার প্রতিবন্ধকতাও কম নহে। তৎসহিত রহিয়াছে সংরক্ষণমূলক শুল্ক-অশুল্ক বাধা, পারস্পরিক বিনিয়োগ জটিলতা; সর্বোপরি বৃহত্তর আস্থার সংকট। কিন্তু বিদ্যমান নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের মধ্যে যেইখানে বৎসরে অন্তত ৬৭ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হইবার কথা ছিল, সেইখানে উহা ২৩ বিলিয়নেরও নিম্নে অবস্থান করিতেছে। স্মরণে রাখা উচিত, দক্ষিণ এশিয়া স্বয়ং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাজার। সার্কভুক্ত আট দেশের জনসংখ্যাই প্রায় দুই শত কোটি। সার্কভুক্ত দেশসমূহের বিপুল ও অপেক্ষাকৃত সস্তা শ্রমশক্তি এবং পর্যাপ্ত খনিজসম্পদ ও কাঁচামালের সম্ভাবনার কথাও ভুলিয়া যাওয়া চলিবে না। অন্যদিকে হিমালয়ের দক্ষিণ পার্শ্বে বাণিজ্য ও বাজার সমৃদ্ধ হইলে অপর বৃহৎ বাজার চীন কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও বাণিজ্য সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাইতে থাকিবে। আলোচ্য সম্মেলনেই বলা হইয়াছে, কৃষি ও তৈরি পোশাক খাতে দক্ষিণ এশিয়া আগামী দশকে নেতৃত্ব দিবে। আঞ্চলিক বাণিজ্য বাড়িলে উহা নিঃসন্দেহে পরবর্তী দশকগুলিতেও সম্প্রসারণ করা সম্ভব।
এই অঞ্চলে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যের অপার সুযোগ থাকিলেও উহা কেন কাজে লাগানো যায় নাই, সেই প্রশ্নের উত্তর সহজ নহে। শুধু পরিসংখ্যান দিয়া উহা সম্পূর্ণ বোঝাও যাইবে না। আলোচ্য সম্মেলনে বলা হইয়াছে, এই জন্য যেইরূপ বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট জাতীয় ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করিতে হইবে, সেইরূপ আন্তঃসীমান্ত যোগাযোগ বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, বেসরকারি খাতের উদ্যোগ, দক্ষ মানবসম্পদের প্রতি জোর দিতে হইবে। কেহ কেহ বলিয়াছেন, জ্বালানি, পরিবহন ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও সহযোগিতা সম্প্রসারণ করিতে হইবে। আমরা এই সকল প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করি না। কিন্তু ভাবিয়া দেখিতে হইবে, এত বৎসর পরও এই সকল নীতি ও কাঠামোগত খাতে অগ্রগতি হইতেছে না কেন? বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশসমূহ অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এই সকল খাতে কম অগ্রগতি লাভ করে নাই। অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ার বাহিরের বিভিন্ন দেশের সহিত এইখানকার দেশসমূহের বাণিজ্য সম্পর্কও যথেষ্ট গতিশীল। শুধু আঞ্চলিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আসিয়া সেই সম্ভাবনা মাথা কুটিয়া মরিয়া যায় কেন?
আমরা মনে করি, দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য ও ব্যবসা সম্ভাবনার মূল প্রতিবন্ধকতা পারস্পরিক অবিশ্বাস বা আস্থাহীনতা। একজন বক্তা যথার্থই বলিয়াছেন, সার্কভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সম্পর্ক স্থাপন করিতে পারিলে এই অঞ্চল হইবে বিশ্বের অন্যতম প্রধান গতিশীল ও উদীয়মান শক্তি। সেই কাজটি সার্ককে গতিশীল করিবার মাধ্যমেই সবচেয়ে ভালোভাবে সম্ভব। কিন্তু যেই লক্ষ্য লইয়া দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাটি গঠিত হইয়াছিল, উহার বহুলাংশ অধরা রহিয়া গিয়াছে। অস্বীকারের অবকাশ নেই, ইতোমধ্যে সার্কের ঝুলিতে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আবহাওয়াবিষয়ক কিছু অর্জন রহিয়াছে। কিন্তু আঞ্চলিক বাণিজ্য সহযোগিতার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালনকারী যোগাযোগ, জ্বালানি, বাধাহীন আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমরা পিছাইয়া রহিয়াছি। বুধবারের সম্মেলনটি তাগিদই দিয়া গেল যে, আক্ষেপের বদলে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপে অগ্রসর হইবার সময় এখনও ফুরাইয়া যায় নাই।
বিষয় : আঞ্চলিক আক্ষেপ সম্পাদকীয় দক্ষিণ এশিয়া
মন্তব্য করুন