
মানুষের জীবনে শৈশব পার হয়ে আসে কৈশোর। এর পর যৌবন। এরই মাঝখানে থাকে কৈশোর তথা বয়ঃসন্ধিকাল। ১০ থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত সময় হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকাল। অর্থাৎ শিশুকাল আর যৌবনের মধ্যবর্তী সময়। কৈশোরের অভ্যাস পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং স্থায়ী আচরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময়েই একজন কিশোর-কিশোরীর মানসিক-শারীরিক তথা আচরণগত নানাবিধ পরিবর্তন ঘটে। এই সময় কিছুটা হলেও মানসিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। সময়ের উদীয়মান প্রজন্মে মূল্যবান জীবনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার সুবর্ণ পর্বে নানা রকম বিভ্রান্তির আবর্তে ধ্বংসের শঙ্কা তৈরি হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞায় যাদের বয়স ১০-১৯ বছরের মধ্যে, তারাই কিশোর-কিশোরী। এটি হলো শৈশব এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার মধ্যবর্তী সময়। এই সময়েই শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের ভিত্তি গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কিশোর-কিশোরী। এ সময়ের মধ্যেই প্রায় ৭০ শতাংশ অসংক্রামক রোগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৫-১৯ বছরের কিশোর-কিশোরীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ সময় যদি সঠিক মানসিক যত্নের অবহেলা করা হয় তবে ১৫-২০ বছর পর একটি মূল্যবোধহীন সমাজ হবে। এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, শিশু-কিশোরদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মৃত্যুই আত্মহত্যাজনিত, যেটি রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়।
এ সময়ে সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতি, প্রথা, আইন, মূল্যবোধ, আদর্শ তথা সমাজের অভিভাবক ও বড়দের সঙ্গে মতাদর্শের পার্থক্য হয়। সম্পর্কের টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয় বলে এই সময়কে ঝড়-ঝঞ্ঝা ও পীড়নের সময়ও বলে। মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত এক প্রকার হরমোনের প্রভাবে বয়ঃসন্ধিকালে যৌনবিষয়ক চিন্তা করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। মনে নানা জল্পনা-কল্পনা ও প্রশ্নের উদয় হয়। কিশোর-কিশোরীরা সংক্রামক, যৌনবাহিত রোগ-ব্যাধিসহ সাধারণ প্রজন্ম স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ব্যাপার গোপন রাখতে চেষ্টা করে। বয়সের বাস্তবতায় অভিজ্ঞতা কম থাকে। তাই খুব সহজেই অন্যের দ্বারা প্ররোচনার শিকার হয়ে বিপথগামী তথা ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
মনের অজান্তেই মাদক, গাঁজা ও হেরোইনে আসক্তি; ছিনতাই, সহিংসতা, নিম্ন সামাজিক মর্যাদা, যৌনবাহিত রোগ, অপুষ্টি, বাল্যবিয়ে, এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণত কিশোরদের চেয়ে কিশোরীরা বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হয়।
বর্তমান সময়ে শিশু-কিশোররা কায়িক শ্রমবিমুখ, অলস-অবোধ। তারা খেলাধুলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। তাতে অপসংস্কৃতির স্রোতে গা ভাসিয়ে নিজের অজান্তেই খুব সহজে সোশ্যাল মিডিয়া, বিভিন্ন গেম্স যেমন পাবজি, ব্লু হোয়েল, ফ্রি-ফায়ার, ফেসবুক তথা মোবাইল ফোনে আসক্তিতে নিমজ্জিত হয়ে ঝুঁকির দোলায় দুলছে। তারা গঠন করছে গ্যাং কালচার।
শরীরের সুস্থতার ওপর নির্ভর করে আগামী দিনের সুখ-ভোগ, পরিতৃপ্তি, সমৃদ্ধ ও সুফলতা। খেলাধুলা শরীর-মন গঠনের অন্যতম উৎস। খেলাধুলার চর্চার মধ্য দিয়ে খুঁজে পায় জীবনের দিশা।
যেহেতু বয়ঃসন্ধিকালীন তথা কৈশোরকালীন একটু ভুল সারাজীবনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে; সামান্য পদস্খলন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার অন্তরায় হতে পারে। তাই এই সময় প্রত্যেক অভিভাবক, শিক্ষক, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের কর্মকর্তা, সাংবাদিক, মিডিয়াব্যক্তিত্ব, সুধীমহল, সচেতন ও বিবেকবান ব্যক্তির গঠনমূলক ভূমিকা থাকা খুব দরকার। কিশোর-কিশোরীদের মানবিক বোধ জাগ্রতকরণ, নৈতিক শিক্ষার চর্চা, গঠনমূলক বই পড়তে উৎসাহ ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষাদান, সাংস্কৃতিক জ্ঞানে সমৃদ্ধকরণে সচেষ্ট হতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের ভালো কাজে পুরস্কার তথা তাদের ইতিবাচক কাজে প্রেষিত করতে হবে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রেরও দায় রয়েছে।
কিশোরদের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। অভিভাবক এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই বিষয়ে জ্ঞান লাভ করতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আদি ঐতিহ্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে হবে। কৈশোরকালীন সঠিক পরিচর্যা সুস্থ-সুন্দর-সঠিক-সুচারু হলেই কৈশোরের ঝুঁকির প্রতিকার করা সহজ হবে। আগামী পৃথিবী হবে সুন্দর।
মোশারফ হোসেন: প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ
mamun86cu@gamil.com
মন্তব্য করুন